• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
দিকহারা শিক্ষা খাত

সংগৃহীত ছবি

শিক্ষা

দিকহারা শিক্ষা খাত

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

স্বাধীনতার অর্ধশতক পর ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে আবারো শিক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় পরের ক্লাসে তুলে দিতে হচ্ছে। যদিও স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো এবার শত্রুপক্ষের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে এবারের লড়াইয়ে এখনো কূলকিনারা করে ওঠা সম্ভব হয়নি।

মহামারীর কারণে মার্চের ১৭ তারিখ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। সংসদ টেলিভিশন, বেতার, কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি ভার্চুয়ালি যতটুকু শিক্ষাকার্যক্রম চালানো গেছে, তাতে আত্মতুষ্টির কিছু দেখছেন না শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শুধু মহামারীর সময় নয়, যে-কোনো ধরনের দুর্যোগের সময় যাতে শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত করে সেভাবে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি নিতে হবে।

এ বছর পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। নতুন বছরে আগের রোল নিয়েই নতুন ক্লাস শুরু করবে শিক্ষার্থীরা। উচ্চ মাধ্যমিকেও এবার চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। এইচএসসি ও সমমানের ফল ঘোষণা করা হবে শিক্ষার্থীদের অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসি ও সমমানের ফলফলের ভিত্তিতে। আর অনলাইনে ক্লাস চললেও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটের মুখে পড়তে যাচ্ছে এবার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মহামারীর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক খাতকে চাঙা রাখার চ্যালেঞ্জ যতটা ভালোভাবে সামলানো গেছে, সে তুলনায় শিক্ষা খাতে ততটা পারা যায়নি। এখানে ফিলোসফিটা হলো- মানুষের জীবন আগে, তারপর শিক্ষা।  তারপরও আমরা ভার্চুয়াল সিস্টেমে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে রেখেছি। কিন্তু এখানে লিমিটেশনটা হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু কোথা থেকে এগিয়েছি? আমরা ছিলাম অনেক অনেক পেছনে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক জায়গায় যোগ্য নেতৃত্ব নেই। মহামারীতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা আছে? অনলাইন এডুকেশন, অনলাইন ডিগ্রি এগুলো আমরা করতে পারিনি। কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে সে প্রশ্নের জবাবে বলেন, একটা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবকাঠামো হয়নি, কোভিডের মধ্যে আমরা এ শিক্ষাটা পেয়েছি। আমরা যেভাবে কাজ করছি, সেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি।

মহামারীর পরে আমরা কীভাবে এগোব, সে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের মধ্যে এসব বিষয় রাখতে হবে, কারিকুলামকে আরো আধুনিক ও স্মার্ট করতে হবে। ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে। স্কুলে দশম শ্রেণির ক্লাস খোলা যেতে পারে, কলেজের দ্বাদশ শ্রেণি খুলে এইচএসি পরীক্ষার্থীদের পাঠদান করা যেতে পারে। অন্য ক্লাসগুলোর একেক দিন একেক ক্লাস খুলে রাখলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, পাঠদানও চলবে।

পড়া মুখস্থ না করিয়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট করালে বেশি শিখতে পারে। কারণ ইনকোর্স দিলে মুখস্থ করে দিতে পারে। শুধু করোনা পরিস্থিতিতে নই, প্রযুক্তি সব সময়ই ব্যবহার করতে হবে। কারিকুলামের ভেতরে এটা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর কনটেন্ট রাখা হয়েছে। কোভিড আমাদের সুযোগ দিয়েছে এটাকে কেটে কমিয়ে দেওয়ার। কারিকুলামের ত্রুটিগুলো ঠিক করতে হবে। মহামারীর মধ্যে বিপাকে পড়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালাতে এখন যেসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোকে পাঠ্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মহামারীর কারণে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেছে। অনলাইনে বা অন্য মাধ্যমে পড়াশোনা ঠিকমতো হয়নি, সকলে পায়নি। যারা পেয়েছে অনেকের ইন্টারনেট ঠিকমতো কাজ করেনি। যারা গ্রামে থাকে, যাদের একসেস নেই, যারা গরিব মানুষ তাদের পক্ষে অনলাইনের খরচ যোগানো সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশের কোম্পানির ইন্টারনেট সেবাও সন্তোষজনক নয়।

ইন্টারনেট কিন্তু ঘন ঘন বন্ধ হয়, একটানা চলে না, মাঝে মাঝে ইন্টারাপ্ট হয়। এটা দিয়ে তো কুলাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে সেখানে যে ভিড় হবে, তা নিয়ে ভাবনা রয়েছে। আমাদের লোকসংখ্যা অনেক। অনেক দেশে স্কুলে তেমন ভিড় হয় না। আমাদের স্কুলগুলোতে অনেক ভিড় হয়। আমরা পিছিয়ে গেলাম। আশায় থাকব যে টিকা আসলে আমরা আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে পারব। শিক্ষায় ক্ষতিটা অন্য যে কোনো কিছুর থেকে বেশি হয়ে গেল।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, আগামী বছরের শুরু থেকে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হয়, তাহলে তিন মাসের কোর্সের ওপর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কার্যক্রম চালু রাখতে চান তারা। আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো খোলা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাটাচমেন্টে রাখা হবে। আমরা মার্চ পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা তৈরি করছি। আশা করছি মার্চের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে। এরপরও যদি খোলা না যায় তাহলে হয়তো আরও তিন মাসের জন্য অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কার্যক্রমে যাওয়া হবে।

ছাত্রছাত্রীদের যে ক্ষতিটুকু হয়েছে তা পরের বছরের পাঠের সঙ্গে ঘাটতি পূরণের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে। নিচের ক্লাসের যে বিষয়টি না পড়ে কোনো শিক্ষার্থী ওপরের ক্লাসে উঠেছে, নতুন ক্লাসে সে ধরনের বিষয় পড়ার সময় আগের ক্লাসের বিষয়টিও পড়ানো হবে। করোনা পরিস্থিতি কমে গেলেও ভার্চুয়াল ক্লাস অব্যাহত রাখা হবে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ডিজিটাল ভার্সন রাখা হবে, যেন শিক্ষার্থীরা যে-কোনোভাবে সেগুলো আয়ত্ত করে নিতে পারে।

ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, মহামারীর মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতি দূর করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ছুটি বাতিল করে অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হয় তাহলে আরো ভালোমতো অনলাইন ক্লাস নিতে ডিভাইসসহ আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো সরকারকে বিনামূল্যে ব্যবস্থা করতে হবে। ২০২১ সালেও যদি অনলাইন ক্লাস চালাতে হয়, তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। কোনো শিক্ষার্থী যেন ঝরে না পড়ে।

 মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, মহামারীর মধ্যে যেভাবে ভার্চুয়ালি শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এসব অব্যাহত থাকবে। ভার্চুয়ালি আরো ভালোভাবে কীভাবে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব। পাশাপাশি বিভিন্ন বিকল্প নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads