• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
এই দৈন্য কাটিয়ে

ছবি : সংগৃহীত

মুক্তমত

এই দৈন্য কাটিয়ে

  • প্রকাশিত ১৪ মার্চ ২০১৯

মিলু শামস

 

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিককেই রাজা হতে হবে- এ বিধান মেনে বাস্তবে দার্শনিকরা রাজা না হলেও সভ্যতার নতুন ইতিহাস নির্মাণের আদর্শিক ভিত তৈরি করেছিলেন দার্শনিকরাই। আঠারো শতকে ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক পটভূমি সেখানকার মানুষের মন আলোকিত করেছিল বলেই দ্রুত বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। সে যুগ ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে এজ অব এনলাইটেনমেন্ট হিসেবে। ফরাসি বিপ্লব শ্রেণিশোষণ বা ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ করেনি, সামন্ততন্ত্রকে আঘাত করেছিল এবং সে সময় তা-ই ছিল তার প্রগতিশীল ভূমিকা। এর অশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ফ্রান্সের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের চেতনা শুধু নয়, গোটা ইউরোপকে এ বিপ্লব আলোড়িত করেছিল। ভাববাদী দর্শনের জায়গায় বস্তুবাদী দর্শন প্রতিস্থাপনের পথ তৈরি করেছিল। রুশো, দিদারো, এলেমবাট, হলবাক, ভলতেয়ার, হেলবেটিয়াসরা ছিলেন সে সময়ের বস্তুবাদী দার্শনিক। সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এদের মতাদর্শিক সংগ্রাম চার্চ ও যাজকতন্ত্রের বাইরে এসে বিজ্ঞানমনস্কতার পথ দেখায়। সে পথ বেয়ে তারা কোথায় পৌঁছেছে, তার সাক্ষী ইতিহাস। আঠারো শতকের আগে আরেক বস্তুবাদ ধর্ম ও ঈশ্বরতত্ত্ব আঁকড়ে বিকশিত হয়েছিল ব্রিটেনে। ফরাসি বস্তুবাদ থেকে যা একেবারে আলাদা। প্রাচ্য দর্শনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এখানে থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে তার যোগ তেমন ছিল না। ইংরেজদের বিদায়ের পর এ অঞ্চলের রাজনীতি ভিন্ন বাঁকে মোড় নিয়েছে।

ভারত বিভাজনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়েছিল পাকিস্তান। ভারতকে চাপে রাখার নেপথ্য কৌশলের এ সখ্য পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত করে। তুরস্ক ও ইরান ছিল পাকিস্তানের সহযোগী এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম। পাকিস্তান যখন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে আঁস্তাকুড়ে তলানোর পাকা বন্দোবস্ত করছে, ভারত তখন রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বিকাশ, ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির পাঠ নিয়ে পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছে। নিজস্ব শিল্প ভিত্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন ভারতের রাজনীতিকেও স্থিতিশীল রেখেছে।

বাংলাদেশ পথ চলেছে মিশ্র পদক্ষেপে। অনেক সময়ই ধনী দেশের গবেষণার কেন্দ্রে থেকেছে। এনজিও মডেলের সফল রূপকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বার বার সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতায় গেছে। অর্থনীতির গতিমুখ শেষ পর্যন্ত কৃষিপ্রধান থেকে সার্ভিস প্রাধান্যে বাঁক নিয়েছে। শিল্পের শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠার আগেই সার্ভিস সেক্টর বিকশিত হওয়ায় ব্যবসায়িক লেনদেন আমদানিনির্ভর হয়েছে। প্রচুর সুপার মার্কেট, শপিং মল হয়েছে। গত পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছরে দেশে আমদানি-রফতানি দুই-ই বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ নেওয়ার হারও বেড়েছে। শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যে নয়, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরির আরো যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য। দেশে একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যাদের হাতে প্রচুর টাকা এবং তা তাদের রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান করেছে। আমদানিনির্ভর পণ্যের ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে এবং এ মানসিকতার জনশক্তি তৈরি হয়েছে।

পড়াশোনার বিষয় হিসেবে এদিকে ঝোঁক ক্রমেই বেড়েছে। পাশাপাশি দর্শন ইতিহাস সাহিত্য সমাজবিজ্ঞানের মতো মৌলিক বিষয়ে আগ্রহ কমছে। একই সঙ্গে রাজনীতি মৌলিকত্ব হারিয়েছে। স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে অথবা এখনো কিছু রাজনীতিবিদ আছেন, যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে সাংগঠনিক চর্চার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছেন। কিন্তু সৃজনশীল রাজনৈতিক চর্চা এড়িয়ে যারা ‘ভিন্নপন্থায়’ রাজনীতিতে এসেছেন, তারা খেই হারিয়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশ সমাজ সময় না বুঝে তারা অন্ধের মতো চলছেন। শুধু ক্ষমতা বদল নয়, বদলানো সময়কে ধরতে পারাও সফল রাজনীতির শর্ত।

সময়ের সঙ্গে কীভাবে একটি দেশ নিজেকে বদলে নেয়, চীন তার উদাহরণ। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে পুরনো শোষকদের উচ্ছেদ করে যুগ-যুগান্তের প্রচলিত কুসংস্কার নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন করে সে দেশে সমাজ বিপ্লব হয়। ১৫১৩ সালে পর্তুগিজরা চীনে পৌঁছানোর পর থেকেই ওই দেশের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহের শুরু। বিভিন্ন অপমানজনক ব্যবসায়িক চুক্তি ও শর্তে চীন এক লাভজনক ব্যবসাকেন্দ্র হয়, বিশেষ করে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাছে। চীনের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের বীজ সঞ্চার মূলত তখন থেকেই। শক্তিশালী বিদেশি দখলদারদের উৎখাত করেছিল চীনের সাধারণ মানুষ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে। পরের সমাজ বিপ্লব হয়েছিল মাঝের দীর্ঘ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও উৎকর্ষের পরিণতি হিসেবে। বিভিন্ন সময় নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনীতি ও রাজনীতির বাঁক ঘুরিয়ে চীন আজ কোথায় পৌঁছেছে! সুতরাং রাজনীতিকরা নিজেদের একটু বদলালে, একটু সময়ানুগ হলে রাজনীতি গতি পায়।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads