• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মুক্তমত

সম্ভাবনার আরেক নাম হাওর

  • মুনযির আকলাম
  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৯

ভাটি বাংলা খ্যাত প্রকৃতির অপরূপ লীলা নিকেতনের বহু বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য এক স্বতন্ত্র সত্তা হাওর তথা হাওরাঞ্চল। হাওরাঞ্চলকে বাংলার শস্য এবং মৎস্য ভান্ডারও বলা হয়ে থাকে। এই হাওরের সম্ভাবনা নিয়ে নেই তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা। নেই লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা এবং হাওরবাসীর সুখ-দুঃখ, সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে তেমন কোনো ভাবনার প্রতিফলন নেই সরকারি ক্ষেত্রেও। অথচ হাওরের মতো বিচিত্র প্রকৃতি ও জীবনধারা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। বর্ষায় চারদিক সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি, পাল তোলা নৌকা, মন পাগল করা মাতাল হাওয়া, ছোট দ্বীপের মতো করে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে, এ সময়ে হাওরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোরম! শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওরাঞ্চলে দেশি ও অতিথি পাখ-পাখালির কলতান, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ ও হলুদ শর্ষে ফুলের দৃশ্যে পরিপূর্ণ হাওরের ধু-ধু মাঠ পরিণত হয় এক নয়নাভিরাম ও নৈসর্গিক লীলাভূমিতে। এ মৌসুমের পড়ন্ত বিকালে মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওরকে শিল্পীর হাতের সুণিপুণ চিত্রপটের রূপ দেয়। যেন প্রকৃতি সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে হাওর। শীত-বর্ষার হাওরের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় হাওরের মাঠে-ঘাটে-বাঁকে।

হাওরের জীবন ও প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্যই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশে ধান এবং মাছের চাহিদা পূরণে যুগে যুগে অবদান রেখে আসছে হাওর। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভান্ডার এবং ধান উৎপাদনের বিশাল ক্ষেত্র। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে। স্বর্ণগর্ভা সোনালি ফসলের মাঠ ও রত্নগর্ভা জলমহালের এই হাওর মৎস্য চাষ আর কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনার দিগন্ত। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জ জেলায় ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার।

আমাদের দেশেও সব রকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা গেলে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। হাওর-বাঁওড়ের হিজল, বেত, করচ, নলখাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানান প্রজাতির বনজ-জলজ প্রাণী আর হাওরপাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। এ দেশে জলাশয় বেশি থাকার কারণে প্রচুর শামুক, ঝিনুক উৎপন্ন হয়। যা প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান। হাসন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সংগীত ভান্ডার। প্রাচীন আখড়া, মন্দির-মসজিদের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে হাওরের সুপ্রাচীন ও গৌরবময় স্মৃতিচিহ্ন। বর্ষাকালে পানিতে আবদ্ধ হাওরবাসীর বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে হাওর এলাকার পর্যটন এবং তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

হাওর-জলাশয়ে সারা বছরই প্রাকৃতিকভাবে নীলাভ স্বচ্ছ মিঠাপানি সংরক্ষিত হয়। এই পানি প্রক্রিয়াজাত করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এই পানি প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করে মোটা অঙ্কের রাজস্ব প্রাপ্তির বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সেদিকে কারো নজর নেই। পানি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগও নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওরের পানি বিক্রি করেই এই অঞ্চলের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। হাওরকেন্দ্রিক ইকো-ট্যুরিজম, মাছ, ধান, বন, খনিজ সম্পদ, রপ্তানিযোগ্য শামুক, ঝিনুক চাষসহ সমন্বিত উদ্যোগ বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপ। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও হাওরকেন্দ্রিক ট্যুরিজমবান্ধব পরিকল্পনা নেওয়া।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads