১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানীরা সব চেষ্টাই করে চলেছেন। এমনকি পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহেও বসতি গড়ার চিন্তায় আছেন তারা! শত চেষ্টার পরও বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে! জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই দিবসটি প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির কাউন্সিল থেকে এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করার আহ্বান জানানো হয়। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন জনসংখ্যার সমস্যা যেমন পরিবার পরিকল্পনা, লিঙ্গসমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
বিশ্বের অষ্টম জনসংখ্যা বহুল দেশ বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বাংলাদেশের আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা অধিক। বহুদিন ধরে প্রায় সব সমস্যা আর সংকটের উপসর্গ হিসেবে এই অধিক জনসংখ্যা বিবেচিত হলেও এর সমাধানও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ভালো খবর হলো ২০১৩ সাল থেকে একই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশেই স্থির রয়েছে। সরকার দেশের জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যা হ্রাসে কাজ করে যাচ্ছে তবু যেন মূল্যবোধ ও সচেতনতার অভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে ক্রমাগত দেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এই অধিক জনসংখ্যাই দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ও প্রধান শহর ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে এক কোটি ৭০ লাখ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে দুই কোটি ৭৪ লাখে। বাংলাদেশের সবচাইতে জনবহুল নগরী রাজধানী ঢাকা। উইকিপিডিয়া বলছে বিশ্বের বৃহত্তম নবম শহর আমাদের ঢাকা। আয়তন ও সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী ঢাকায় সর্বাধিক ৩০ লাখ লোক সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে পারে; কিন্তু সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বিভিন্ন কাজে প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় আসছে, অনেকেই স্থায়ী বাস করছে। ফলস্বরূপ ক্রমান্বয়ে ঢাকা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অতিরিক্ত লোকসমাগমের কারণে বসতি নির্মাণের জন্য খালবিল, পুকুর, নদী ভরাট করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেটে ফেলা হচ্ছে বনাঞ্চল। কর্মসংস্থানের কারণে নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন কলকারখানা। ক্রমাগত নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, সারা দেশে প্রায় সব ছোট-বড় শহরগুলোর একই দশা। অপর্যাপ্ত যানবাহন, কর্মসংস্থান ও খাদ্য চাহিদা মেটাতে শহরগুলোর নাভিশ্বাস। পুরো দেশের সামগ্রিক পরিবেশ একটা চাপের মধ্যে আছে। ফলে যখন তখন বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে দেশে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে তবে জনসংখ্যার বাধা উন্নয়নে ধীর গতি আনছে। জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে দেশে। বসতি গড়ার ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। বাড়ছে পানি, খাদ্য, বস্ত্র, বিদ্যুৎ, যানবাহন ও জ্বালানির চাহিদা। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশকে। ক্রমেই দূষণ ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ। আমরা সজাগ ও সচেতন হলে এই মাত্রাধিক দূষণ থেকে দেশকে বাঁচাতে পারি। জনসংখ্যার হিসাবমতে, দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক তরুণ। যাদের কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে ভাগীদার করা সম্ভব। অধিক জনসংখ্যা সমস্যা নয়, অধিক জনসংখ্যাই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনায় পরিণত হতে পারে। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। বিরাট এই জনগোষ্ঠীকে বেকার রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই এদের কর্মসংস্থান তৈরি করাটা অতীব জরুরি। একটি জাতীয় পত্রিকার জরিপ বলছে, গত ১০ বছরে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, তার অনুপাতে কর্মসংস্থান তিন ভাগের দুই ভাগ কমে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে বিদেশি বিনিয়োগে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ বিদেশিরা ঠিকই বিনিয়োগ করছে কিন্তু সেখানে বেকারদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত অর্থ কিছু সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় সংগঠন প্রকল্প কিংবা অন্য কাজে বণ্টন করলেও তাতে বেকার শ্রেণি উপকার পাচ্ছে না। এতে করে চাহিদা অনুযায়ী নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় পিছিয়ে থাকছে শিক্ষিত বেকাররা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারা দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার জন। এসব বেকারের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী যারা উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। তাই বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বেকারত্ব শূন্যের কোঠায় আনার সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত এবং দেশের অভ্যন্তরে বেশি বেশি কর্মক্ষেত্র তৈরি করে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। কথায় আছে, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করছে, কিন্তু তবু দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে তা অপ্রতুল। সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার প্রায় ৭০ ভাগ। নিরক্ষরতার হার একটি জাতিকে বরাবরই উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে। দেশের সরকার সাক্ষরতার হার বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অতীতের তুলনায় সাক্ষরতার হার বর্তমানে বেশি কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম। কথায় আছে, শিক্ষিত জাতি দেশের বোঝা নয়- সম্পদ। শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ানো সাধারণ মানুষের একটি স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার এই বাণিজ্যকে রুখতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শিক্ষা সুলভভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই দেশ হবে শিক্ষিত আর উন্নত।
লেখক : প্রাবন্ধিক
imparfectheemel@gmail.com