• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
প্রসঙ্গ যখন চিকিৎসা-বাণিজ্য

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

প্রসঙ্গ যখন চিকিৎসা-বাণিজ্য

  • শামীম শিকদার
  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০১৯

চিকিৎসাসেবা প্রতিটি মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। অসুস্থ হলে প্রতিটি মানুষকে সহযোগিতা নিতে হয় ডাক্তার ও হাসপাতালের। কিন্তু সর্বত্র চিকিৎসা বাণিজ্যের বেড়াজালে আটকা এখন মানুষ। ভুয়া চিকিৎসা, ওষুধ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, টেস্ট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানান কিছু নিয়ে মানুষকে পড়তে হয় বহুমুখী হয়রানিতে। এত কিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত মানুষ পায় না সঠিক চিকিৎসা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যাঙের ছাতার মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর মূল কারণ। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার, অপারেশন থিয়েটারের মতো স্পর্শকাতর অংশে পরিচ্ছন্নতার অভাব—এমন চিত্র এসব ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বিরল নয়।

বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর জীবন নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। নানান নিয়মকানুন দেখিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বিরাট অঙ্কের অর্থ। রোগীর পরিবারের লোকজন ভিটেমাটি বিক্রি করে হলেও সে অর্থ দিতে রাজি হয়। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ওষুধপত্র সবকিছুই কিনতে হয় রোগীর পরিবারকে। তারপরেও ডাক্তার, নার্সের সেবার ভোগান্তি তো রয়েছেই। পুরো হাসপাতালজুড়ে থাকে দালালের দৌরাত্ম্য। ডাক্তার আছে, নার্স নেই; নার্স আছে, ডাক্তার নেই—এমন চিত্র বিরক্তিকর। ডাক্তার নার্স পেলেও সেবা নেওয়ার জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। তা ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ নার্স অদক্ষ। কম বেতনে অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ নার্স রাখা হয়। যাদের অনেকেই বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে অক্ষম। এ ছাড়া একজন রোগীর ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন অন্য রোগীর ফাইলে রেখে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। ডাক্তার-নার্সদের অবহেলা, দুর্ব্যবহার, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাব দেখানোর চিত্রও কম নয়। ডাক্তারদের অদক্ষতার কারণে ভুল চিকিৎসা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রোগীর শরীরে পুশ করে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটানো হচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তার খুঁজে পাওয়া গেলেও অনেক হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটে রোগীর। 

স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতাল সিলগালা করলেও পরবর্তী সময়ে ঠিকই চালু করা হয় হাসপাতালগুলো। এমনকি, ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিহতের স্বামীকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এসব ঘটনার কারণে হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তা সাময়িক। এমন ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় হয়ে থাকে। তার প্রমাণ মেলে পত্রিকার পাতায়। আর যারা চিকিৎসা নিতে সক্ষম হচ্ছে তাদের পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার অপ্রয়োজনীয় টেস্ট বাণিজ্যে। ওসুধ কোম্পানিগুলো থেকে ডাক্তার নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন নিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছে নিম্নমানের ওষুধ। অপ্রয়োজনীয়ভাবে করা হচ্ছে সিজার অপারেশন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোর আয়ের ৯৫ ভাগ উৎস হচ্ছে সিজার অপারেশন। যা ৭৭ ভাগ অপ্রয়োজনীয়।

অন্যদিকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশ করা বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসাবের তথ্যানুযায়ী, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকে খরচ করে। বাংলাদেশের কাছাকাছি খরচ হয় আফগানিস্তানে, সেখানে ৬৪ শতাংশ। আর মালদ্বীপে সবচেয়ে কম, ১৮ শতাংশ। ২০১২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্রে বলেছিল, রোগীর নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে সরকার। ২০৩২ সালে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে গত সাত বছরে নিজস্ব ব্যয় কমেনি, বরং বেড়েছে।

শুধু মুখের কথায় এসব সমস্যা দূর হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ কাজে আধুনিক প্রযুক্তিরও সহায়তা নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনের সংস্কারও করতে হবে। আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়াটাও জরুরি।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads