• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ফাইল ছবি

মুক্তমত

পৃথিবীর আদিঘরের ইতিহাস

  • সৈয়দ আবুল হোসেন
  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০১৯

পবিত্র কাবাঘরকে দুনিয়ার প্রাচীনতম পবিত্র স্মৃতিচিহ্নের একটি মনে করা হয়। কাবাঘর প্রথম নির্মাণ করেছিলেন আদম (আ.)। কেউ কেউ বলেন, এটা প্রথম বানিয়েছিলেন ফেরেশতাগণ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন যে জমিন সৃষ্টি করেছিলেন, তার প্রথম ধাপ ছিল এই কাবাঘরের স্থানটি। প্রথমে এটা পানির বুদবুদের মতো ছিল। এ থেকেই সারা দুনিয়ায় মাটি বিস্তার লাভ করে।

নূহ (আ.)-এর আমলে সংঘটিত মহাপ্লাবনের সময় কাবার স্থানটিকে আল্লাহপাক তুলে নিয়েছিলেন। পরে ইব্রাহিম (আ.) নতুন করে কাবাঘরের পত্তন করেন। তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) কাবা নির্মাণে পিতার সঙ্গে শ্রম দেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক স্বয়ং কাবাঘর নির্মাণের এই ইতিহাস লিখে দিয়েছেন, ইব্রাহিম ও ইসমাইল একত্রে মিলে কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করে (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৭)।

আমি ইব্রাহিমকে সেই ঘরের চিহ্ন বাতলে দিই, ইব্রাহিম আল্লাহর হুকুমে এই ঘর নতুন করে গড়ে তোলে (সুরা হজ, আয়াত : ২৬)।

মানবজাতির সর্বশেষ নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন ৩৫ (তখন তিনি নবী হননি), তখন মক্কার কুরাইশগণ কাবাঘর নতুন করে নির্মাণ করেন। স্বয়ং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্মাণে শরিক হয়েছিলেন এবং কাঁধে করে পাথর জোগান দিয়েছিলেন। এ সময়ে কাবাঘরে হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যস্থতায় তা নিরসন হয়। তবে হালাল টাকার অভাবে হাতিমের দিকে দেওয়ালের কিছু অংশ পিছিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে মূল কাবার কিছু অংশ বাইরে থেকে যায়। নবী (সা.)-এর ইচ্ছা ছিল, তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর মূল ভিত্তির ওপর নতুন করে কাবাঘর নির্মাণ করবেন; কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

হিজরি ৬৪ সালে মক্কার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কাবাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজিদের সেনাবাহিনী আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.)-কে আক্রমণ করতে কাবাঘরে গোলা নিক্ষেপ করলে দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় এজিদের মৃত্যু হয়। পরে আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাবাঘর নতুন করে গড়ে তোলেন। হাতিম ঘরের ভেতর চলে যায় এবং দরজা নিচু করে আরো একটি অতিরিক্ত দরজা তৈরি করা হয়। এতে তাওয়াফকারীরা এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। খলিফা অলিদ ইবনে আবদুল মালেকের আমলে পুরনো কুরাইশ মডেলে কাবাঘর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে পুনর্নির্মিত হয়। আজ আমরা যে কাবাঘর দেখি তা এই আমলেই তৈরি হয়েছিল। আল্লাহপাকের নির্দেশে যখন কেয়ামত কায়েম হবে, তখন সর্বপ্রথম কাবাঘরকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হবে। কেয়ামতের অনেক আলামতের একটি হবে এই যে, আফ্রিকার হাবশার লোকেরা কাবাঘর আক্রমণ করবে।

 

কালো পাথরে সোনার আবরণ

কাবাঘরের কালো পাথরটি নিয়ে অনেক কাহিনী এবং গল্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, এটা জান্নাত থেকেই এসেছে। আদম (আ.) দুনিয়ায় আসার সময় এটি নিয়ে এসেছিলেন। কালো পাথরটি (হজরে আসওয়াদ) মাটি থেকে ১ দশমিক ৫ মিটার উপরে কাবার পূর্ব কোনায় অবস্থিত। মহানবী (সা.)-ও উল্লেখ করেছেন, পাথরটি বেহেশত থেকে এসেছে। ইব্রাহিম (আ.) আবু কুবাইশের নিকটস্থ পাহাড় থেকে এটি এনেছিলেন, যখন তিনি তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর সঙ্গে কাবাঘর নির্মাণ করছিলেন। তিনি এটি হাজিদের জন্য কাবাশরিফ প্রদক্ষিণের শুরু এবং শেষের বিন্দু নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করেন। প্রত্যেককে একবার কাবা প্রদক্ষিণ শেষে একবার এর গায়ে চুমু খেতে হয় অথবা সালাম জানাতে হয়। এটাই রীতি। তবে এরকম করা ওয়াজিব নয়।

নবুয়ত প্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ৩৫, তখন তিনি কাবাবিষয়ক একটি ঘটনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। আগুনের ফলে কাবার কাঠামোটি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এর ফলে সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়, যার কারণে কাবার কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। সংস্কার কাজের সময় আরব গোত্রগুলোর মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়। প্রত্যেক গোত্রই কাবার দেয়ালের একটি অংশ সংস্কারের জন্য নির্বাচন করে এবং দেয়ালের পাথর ভাঙার মাধ্যমে তারা তাদের কাজ শুরু করে। পূর্ব কোনায় অবস্থিত পবিত্র কালো পাথর খুব সতর্কতার সঙ্গে অপসারণ করা হয় এবং এক পাশে রাখা হয়। যখন সময় এলো কালো পাথরকে পুনরায় নির্ধারিত স্থানে রাখার, তারা একমত হতে পারল না, কোন গোত্র এই সম্মান লাভ করবে এ ব্যাপারে। বিবাদ এতটাই চরমে উঠল যে, রক্তপাত মনে হচ্ছিল অবশ্যম্ভাবী। তখন হুদায়ফা নামক এক কুরাইশ বললেন, ‘ভাইয়েরা, এসো আমরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করি। আমার একটি প্রস্তাব আছে। আসো, আমরা কাবার প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশকারী পরবর্তী লোকটির জন্য অপেক্ষা করি এবং তার হাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিই। প্রত্যেকে সম্মত হলো এবং তারা সবাই মিলে অপেক্ষা করতে লাগল। ঘটনাক্রমে পরবর্তী লোকটি, যিনি ওই দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন, তিনি ছিলেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁকে তারা ‘আল-আমিন’ বা ‘বিশ্বাসী নামে ডাকত। তাদের সবার দাবি শুনে তিনি এক মুহূর্ত ভাবলেন এবং বললেন, ‘আমাকে এক টুকরো কাপড় দাও। তাঁকে কাপড় দেওয়ার পর তিনি মাটির ওপর কাপড়টাকে বিছিয়ে দিলেন এবং এটার মাঝখানে কালো পাথরটিকে রাখলেন।

তিনি প্রত্যেক গোত্রের দলপতিকে কাপড়ের কোনা ধরতে বললেন এবং সবাই মিলে কালো পাথরটিকে এর নির্ধারিত স্থানের কাছে রাখলেন। তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এটিকে এর নির্ধারিত জায়গায় স্থাপন করেন। সব গোত্রই সন্তুষ্ট হলো এবং সংস্কার কাজ বিবাদ ছাড়াই এগিয়ে চলল।

উমাইয়াগণ কর্তৃক ৭৫৬ সালে মক্কা অবরোধের সময় গুলতি থেকে ছোড়া একটি পাথর কালো পাথরকে আঘাত করে এবং এটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের টুকরোগুলোকে রুপার তারের সাহায্যে জোড়া লাগিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন।

পবিত্র কাবাঘরের তালাচাবি

ইসলাম-পূর্ববর্তী অথবা ইসলাম-পরবর্তী, সকল সময়ই কাবাঘরের চাবি ছিল কুরাইশদের হাতে। আজো এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি একবার কাবাঘরে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কুরাইশ নেতা উসমান ইবনে তালহা তখন কাবাঘরের চাবির দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু উসমান তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে উসমান! আশা করি একদিন তুমি আমাকে এমন অবস্থানে দেখবে যে আমি আমার ইচ্ছামাফিক এই চাবি যে কোনো স্থানে রাখব এবং যাকে ইচ্ছা তাকে এর দায়িত্ব দেব।’ উসমান উত্তর দিল, ‘তাহলে বোঝা যাবে কুরাইশদের বিনাশ হয়েছে এবং তারা শক্তিহীন। ওই সময় কাবাঘর বৃহস্পতি ও সোমবার সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হতো। এটার প্রহরীরা এর প্রবেশদ্বারে বসে থাকত এবং যাদের ইচ্ছা ঢুকতে দিত এবং বাকিদের সিঁড়ি থেকে লাথি মেরে বিদায় করত। মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সব পদের অধিকারীদের বরখাস্ত করেন শুধু তীর্থযাত্রীদের পানি সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং যারা চাবির দায়িত্বে ছিল তাদের ছাড়া। তিনি প্রথম দায়িত্বটি অর্পণ করেন তাঁর চাচা আব্বাসকে, যিনি দীর্ঘকাল ধরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পরবর্তী দায়িত্বটি কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি উসমান ইবনে তালহাকেই প্রদান করেছিলেন। ওইদিন থেকে যখন প্রয়োজন হয়েছে তখনই এর দরজা খুলেছে এবং বন্ধ হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে চাবিগুলোর নকল তৈরি করা হয়েছে এবং এরকম পুরনো কিছু চাবি আমি ইস্তানবুলের পবিত্র জামা সংরক্ষিত ঘরে দেখেছি। যখনই চাবিগুলো ইস্তানবুলে এসেছে এগুলো দাবুতপাশা অথবা সারায়বুরনুতে আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে বরণ করা হয়েছে।

কাবার চাবি অটোমান রাজধানীতে পাঠানোর ঐতিহ্য শুরু হয় মক্কার গভর্নর আবু আল বরকতের সময়। তিনি একটি তালাসহ কাবাঘরের চাবি সুলতান প্রথম সেলিমের মিসর বিজয়ের পর ১৫১৭ সালে অটোমান রাজধানীতে পাঠান। সোনা ও রুপার প্রলেপ দেওয়া চাবি এবং তালার ওপর সুলতানের নাম, তারিখ, কোরআনের আয়াত এবং প্রশংসাসূচক কবিতা খোদাই করা থাকত। তুরস্কের সুলতানরা বিভিন্ন সময়ে সেনা অভিযানের সময় চাবিগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতেন এই আশায় যে, ওগুলো সৌভাগ্য এবং বিজয় নিয়ে আসবে।

তবে ইস্তানবুলের জাদুঘরে প্রদর্শিত চাবিগুলো শুধু কাবার নয়। সেখানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারকের, মসজিদে নববীর ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের সোনা, রুপা এবং লোহার চাবি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমাধির দরজার পুরনো তালা (সম্মানিত কক্ষ যা, হুজরা আল শরিফ নামেও পরিচিত, যার মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাস করতেন এবং যেখানে তিনি সমাহিত আছেন) এবং ইমাম আবু হানিফার সমাধির চাবিও ওখানে রাখা আছে।

লেখক : রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads