• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২০ জুলাই ২০১৯

অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাবা-মা সন্তানদের লেখাপড়া করান। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তাদের বিষয় ভিন্ন; কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের সন্তানকে মানুষ করতে বাবা-মাকে অসহনীয় পরিশ্রম করতে হয়। খেয়ে না খেয়ে সন্তানের বিদ্যালয়ের ফি পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সেই সন্তান যখন বছর শেষে পরীক্ষায় একের পর এক অকৃতকার্য হয়েই যায়, তখন বাবা-মার স্বপ্নভঙ্গের করুণ চিত্র তাদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। আর এই স্বপ্নভঙ্গের অন্যতম কারণ হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তন হতে থাকে। এ সময়টায় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। আধুনিকতার ছোঁয়া অবশ্য ছেলেমেয়েদের অনেকটাই বিগড়ে দিয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।  

একদিকে বয়সের উগ্রতা অন্যদিকে যোগাযোগমাধ্যম ও পশ্চিমা সংস্কৃতি ঠিক যেন ‘এমনিতেই নাচুইন্না বুড়ি তার ওপর আবার ঢোলের বাড়ি’ প্রবাদের কথাটির মতো। ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখে দেখে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের মানসিকতার যে পরিস্থিতি তাতে মাধ্যমিক কেন, প্রাথমিক শিক্ষাকাল থেকেই তাদের মাথায় প্রেমের ভূত আছর করে। এমনও ঘটনা দেখেছি, বয়স এখনো ১৪ পার হয়নি কিন্তু ছেলেমেয়ে উভয়ে একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্কগুলোতে নোংরামি করছে। 

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অন্যায় কিছু নয়, এটি অস্বীকার করার উপায় বা সাধ্য কারো নেই। তবে সবকিছুরই উপযুক্ত সময় রয়েছে। যখন জীবনকে গড়ার সময়, ঠিক তখন এসবে জড়ানো মানে জীবনে দুঃখকে নিশ্চিতভাবেই আলিঙ্গন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি সতেজ বীজকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার শামিল এটি। কিশোর বয়সে তাদের সব চিন্তাই যেন একমুখো। প্রেমটাই যেন সব তাদের কাছে। বাকি সব অর্থহীন। যে কারণে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কিশোরী মেয়ে প্রেমের ফাঁদে পড়ে জীবন নষ্ট করছে। প্রকৃতপক্ষে পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যতটুকু জেনে থাকি তার থেকে বহু গুণ বেশিই প্রেমজনিত কারণে মেয়েদের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। অমূল্য সম্পদ যেমন যত্নের অভাবে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনই সন্তান জন্ম দিয়ে ঠিকমতো গড়ে তোলা না হলে তারাও নষ্ট হয়ে যায়। 

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। দুদিন আগে রাতে কাজ শেষে করে চার্জে চালিত অটো গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছি। আমার সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষার্থী (একজন ছেলে আর দুজন মেয়েও) গাড়িতে উঠে বসল। ওরা সম্ভবত কোচিং শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। কিছুদূর আসতেই দেখলাম একজন মেয়ে ছেলেটির কাঁধের ওপর হাত দিয়ে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসল আর ছেলের মোবাইলে দুজনে ফেসবুকিং শুরু করল। ওদের ভাবসাব দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলাম বৈকি। মনে মনে ভাবলাম এভাবেই বুঝি প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।  

একবার ভেবে বলুন এখানে ভুলটা কার। আমরা অভিভাবকরা কি এতটাই উদাসীন আমাদের সন্তানদের বিষয়ে! সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের খুশিমতো ছেড়ে দিলে তো তাদের যাইচ্ছেতা করে বেড়াবেই। রাতের বেলা কোচিং বা প্রাইভেট যেখানেই আপনার সন্তানকে পড়ান না কেন, আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করি কমপক্ষে এইচএসসি লেভেল পর্যন্ত সঙ্গে থেকে আনা-নেওয়া করতে হবে। টিনএজরা বর্তমানে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে তা মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় সময়ই জানতে পারি। গা শিউরে ওঠা একের পর এক সব ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা। এমনকি বড় বড় কিলিং গ্রুপ বা নিজেরাই কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি করে চাঞ্চল্যকর অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে। কাজেই অভিভাবকদের সন্তানদের কিশোর বয়সের এ সময়টায় আরো সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের সামান্য অসচেতনতার কারণে সন্তানদের সারা জীবন ভুলের মাশুল গুনতে হয়। আর সন্তানের এমন করুণ পরিণতিতে সেই অভিভাবকদেরই আবার সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতে হয়। এক্ষেত্রে পুরনো ঢোল আবারো বাজাতে চাই, সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের দূরত্বটা কমিয়ে আনতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে সন্তানরা নির্ভয়ে তাদের সব কথা পিতামাতার কাছে বলতে পারে। কোথায় কখন কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে সব খবরই একজন অভিভাবককে রাখতে হবে। আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় একটু গরমিল পেলেই খতিয়ে দেখতে হবে, কেন সন্তান এমন আচরণ করছে।  

সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। প্রয়োজনে সন্তানের বন্ধুদের সঙ্গেও মিশতে হবে। স্কুলে থাকার সময় তাদের চালচলন অনুধাবন করার জন্য শ্রেণিশিক্ষকের সঙ্গেও বসতে হবে। রাতে বাসায় পড়ার টেবিলে বসে বই পড়ছে না অন্য কিছুতে মেতে রয়েছে, সেটিও নজরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য বাবার থেকে মায়ের ভূমিকা বেশি থাকে। সন্তানদের কিছু চাহিদাও তাদের ইচ্ছেমতো পূরণ করতে হবে।  

তবে সব আবেদনই যে রাখতে হবে এমনটা কিন্তু নয়। অনেক ছেলেমেয়ে আছে নিজেদের পছন্দের কিছু পেতে ভীষণ ধরনের পাগলামিও করে থাকে। তখন অবশ্য খুব সতর্কতার সঙ্গেই তাদের ম্যানেজ করতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের বিপদও ঘটে যেতে পারে। তবে অবশ্যই তাদের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে নয়। সন্তানের জন্য আদর অন্তরে থাকুক, মুখে নয়। বিশেষ করে এনড্রোয়েড মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। শুধু প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া যতটা সম্ভব ইন্টারনেট থেকে সন্তানদের দূরে রাখাই শ্রেয়। প্রয়োজনে সঙ্গে নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার বা শিক্ষাবিষয়ক সাইটগুলো ব্রাউজ করা যেতেই পারে। পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং বিদেশি মিডিয়া আগ্রাসন থেকেও যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখা যায় ততটাই শ্রেয়। 

পরিশেষে, ভালো-মন্দ সবদিকই তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অভিভাবকদের শত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানের জন্য সময় বের করতে হবে এবং রুটিনমাফিক সেভাবে চলতে হবে। তবে সন্তানদের সঙ্গে কোনোভাবেই উচ্চবাচ্য বা অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। সন্তান ভুল করতে পারে, তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। ভুল শুধরে দিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে।  

লেখক : প্রাবন্ধিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads