• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
মানবিক বাঙালি নিঠুর কেন?

ছবি : সংগৃহীত

মুক্তমত

মানবিক বাঙালি নিঠুর কেন?

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ২৫ জুলাই ২০১৯

বাঙালির ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতা, উদারতা, সহনশীলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আর সম্প্রীতির মেলবন্ধন শত শত বছর ধরে প্রশংসিতই ছিল। কালের পরিক্রমায় সে পরিচয় যেন অসুর আর পশুর দখলে চলে গেছে।

কীভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশের মানুষ স্রেফ একটি গুজবে কান দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করছে! মানবিকতা আর মূল্যবোধ কতটা অতলে তলিয়ে গেলে মানব মনে পশুর হিংস্রতা ভর করে। রাষ্ট্র কেন এর কারণ খতিয়ে দেখছে না, প্রতিকারে উপযোগী ব্যবস্থার খোঁজ করছে না? মানুষের মানবিক বৈকল্যের এ দায় কার?

সময় পরিক্রমায় সামাজিক অস্থিরতা দমনে রাষ্ট্রের যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, তা যথাযথ নয় বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। খাদ্যে ভেজাল, বিচারহীনতা, সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস, প্রযুক্তির জোয়ারে সর্বস্তরের পরিবর্তন আর বিভাজন মানুষকে যতটা আত্মকেন্দ্রিক করেছে, মূল্যবোধেও ততটা বৈকল্য করেছে। এ জন্যই সামান্য অপরাধে বা অপরাধের অজুহাতে নিজের ক্ষোভ-খেদ অন্যের ওপর অনায়াসেই চরিতার্থ করছে। যে ক্ষোভের সমাপ্তি হয় চরম হিংস্রতা আর নির্মম নৃশংসতা দিয়ে।

সহজ-সরল এ বাঙালি কেন এমন নির্দয় হয়ে উঠছে? এর নেপথ্যে কী? এ প্রশ্নের উত্তর কে চাইবে কার কাছে—সে শৃঙ্খলা থেকেও অনেক দূরে সরে গেছি আমরা। শুভবোধ হারিয়ে ফেলেছে সমাজের একটি অংশের মানুষ।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে আমরা জানতে পারি, বিচার নেই বলে এমন নৃশংসতা নতুন নতুন মাত্রা পায়, এবং চলতে থাকে একের পর এক। প্রতিকারের বিষয়টি অনেক দেরিতে কড়া নাড়ে আমাদের ভোতা বিবেককে।

কী জঘন্য! কত নিষ্ঠুর! নির্দয় মানুষ অসুরের ভূমিকায় নিরপরাধ মানুষকে অপরাধের প্রমাণ ছাড়াই পিটিয়ে নৃশংস কায়দায় নির্মমভাবে হত্যা করছে। আহ্ একজন নিরপরাধের প্রতি এমন নৃশংস অবিচারের দুঃসহ সংবাদ মানবিক হূদয়কে দগ্ধ করে দেয়। নির্মম কষ্টের যন্ত্রণা যেন দেহের শিরা-উপশিরা অচল করে ফেলে। গত কদিনে দম বন্ধ হয়ে আসা এ খবরগুলো পড়তে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছি আমি এবং আমার মতো অনেকেই। ‘ছেলেধরা সন্দেহে বাড্ডায় গণপিটুনিতে নারী নিহত’ জানা গেল তাসলিমা নামের ওই নারী নিরপরাধ। নিজের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য তথ্য জানতে গিয়েছিলেন তাসলিমা। ৮-১০ দিনের মধ্যে এমন ১০টি দুঃসহ যন্ত্রণার মৃত্যু সংবাদ আমার মতো এ দেশের অনেক মানুষের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল। শুধু হা-হুতাশ আর চোখ ভেজা খবরগুলো আফসোস-অনুশোচনায় একে-অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তবে দুদিন আগে জানতে পেরেছি, দেরিতে হলেও আমাদের ভোতা বিবেকের ঘুম ভেঙেছে। দেশের প্রতি জেলায় পুলিশকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০ জন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ গেছে গুজবের ঘটনায় এবং আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ।

সময়ের ব্যবধানে অপরাধের মাত্রা বাড়লেও বিচারের জন্য সেকেলে আইনের দারস্থ হতে হয় আমাদের। এ জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার দুর্বল বিচারব্যবস্থায় পার পেয়ে যায় অপরাধী। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে আমজনতা তোয়াক্কা করছে না আইনকে। আইনপ্রয়োগকারীদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বলেই আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে।

দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি—বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে, অথচ নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করছে! এ কীসের উন্নয়ন? যেখানে শিক্ষানীতির যুগোপযোগী সংস্কার নেই, যে দেশে একজন হুজুরের কথায় পাঠ্যসূচি পরিবর্তন হয়, ধর্ষণের বিচার হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, দেশের ৭০ ভাগ মানুষ এখনো হুজুরের পানিপড়া আর তাবিজ-কবজে বিশ্বাস হয়ে জিন-ভূতের আত্মীয়স্বজন হয়ে আছে, সে মানুষগুলোর বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল কাতারের দেশে প্রবেশ করছে। এটি একদিকে সুখবর হলেও অনেক বিষফোঁড়া দেশটিকে বারবার কাঁদিয়েই চলেছে। যেমনটা বলা যায়, নির্বোধের হাতে ধারালো অস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের চিত্র। প্রযুক্তির ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে অপরাধ এখন নানামুখী মাত্রা ছাড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিষধর সাপে পরিণত হয়েছে। এর অপব্যবহারই ধর্ষণ আর শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ বাড়তে ভূমিকা রাখছে।

দারিদ্র্যক্লিষ্ট থেকে মাত্র বেরিয়ে আসা উন্নত অবকাঠামোর দেশে বিশ্বায়নের প্রবল স্রোত টালমাটাল করে দিচ্ছে অর্ধশিক্ষিত বাঙালিকে। কল্যাণের প্রযুক্তিতে অকল্যাণের কী আছে তা না জেনেই দেদার ব্যবহার হচ্ছে। ঠুনকো আবেগি ইচ্ছেগুলো হাতের মুঠোর অন্তর্জালে সাঁ সাঁ করে বেড়ে উঠছে অপরাধী হয়ে।

অন্যদিকে অনুকরণপ্রিয় বাঙালির স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের হাজার হাজার অশ্লীল ভিডিও নামে-বেনামে ঘুরছে নেট দুনিয়ায়। এদের অধিকাংশই বয়সী জোয়ারের উন্মত্ততায় নিজেকে ফাঁদে ফেলেছে সরল বিশ্বাসে। আহ্লাদি অভিভাবকরা আবদার মেটাতে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছে নেট দুনিয়ার যন্ত্রটি। যার ভালো-মন্দের ব্যবহারিক জ্ঞান নেই সেই ছেলেমেয়েদের হাতে। যেখানে ভোগের ইচ্ছাকে প্রবল করে তোলার অজস্র উপাদান উসকানি দেয়।

উন্নয়নশীলতার বেঘোর দৌড়ে প্রযুক্তি বিপণনে যে ভুলটা হয়ে গেছে তা শোধরানোর সময় এখনো আছে। প্রযুক্তিপণ্য আর প্রযুক্তির ব্যবহার উপযোগিতা বুঝেই নির্দিষ্ট করা হলেই সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads