• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আপসেই কি মুক্তি খালেদা জিয়ার

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

আপসেই কি মুক্তি খালেদা জিয়ার

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১০ আগস্ট ২০১৯

গত ৩১ জুলাই হাইকোর্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিনের আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আবারো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মোট ৩৭টি মামলার মধ্যে ৩৫টি মামলায় এরই মধ্যে জামিন পেয়েছেন তিনি। দণ্ডপ্রাপ্ত মামলা দুটিতে জামিন পেলেই তার মুক্তি মিলতে পারে। বিএনপির যেসব নেতাকর্মী তাদের নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন, জামিন আবেদন নাকচ হওয়ায় তেমনি আশাহত হয়েছেন।

উনিশ মাস ধরে জেলবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন। এ সময়ের মধ্যে তাকে মুক্ত করার বিষয়ে বিএনপি নেতাদের মুখে নানা কথা শোনা গেলেও তার কার্যকারিতা আজো দেখা যায়নি। ‘তুমুল আন্দোলন’ গড়ে নেত্রীকে মুক্তি দিতে সরকারকে বাধ্য করার হুমকি বিএনপির শীর্ষনেতারা বহুবার দিয়েছেন।‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে গদিচ্যুত করে’ খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার হুংকারও শোনা গেছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে সরকারকে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলা তো দূরের কথা, রাজধানীতে একটি বড় বিক্ষোভ মিছিলও তারা করতে পারেননি। বরং খালেদা জিয়ার মুক্তিকে পুঁজি করে দলটির একশ্রেণির নেতা বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলছেন- এমন অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল পর্যায় থেকে। এরই অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদে দলের নির্বাচিত পাঁচ প্রার্থীর শপথ এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনে অংশ নেওয়াও হয়েছে। তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ- শপথ নেওয়ার সময় তারা বলেছিলেন, নেত্রীর মুক্তির দাবিতে সংসদে ঝড় তোলার জন্যই তারা শপথ নিচ্ছেন। এমনকি এমন কথাও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এমপিরা শপথ নিলে বেগম জিয়ার মুক্তির পথ খুলে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি এ যাবত যা করেছে তাহলো, দলের কেন্দ্রীয় ও গুলশান কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং, প্রেস ক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘প্রতিবাদ সভা’ এবং তোপখানা রোডে মানববন্ধন। আর দলটির ‘দপ্তরবাসী’ নেতা রিজভী আহমেদ মাঝে মাঝে গুটিকয়েক লোক নিয়ে অতিপ্রত্যুষে কিংবা সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে নয়াপল্টনের রাস্তায় ঝটিকা মিছিল বের করে চমক সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। এসব কর্মসূচি যে দেশের রাজনীতির সমুদ্রে তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেনি তা বলা নিষ্প্রয়োজন। অবশ্য গত মাসে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় তিনটি বড়সড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। তবে সে সব সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেতাকর্মীরা পাননি। একটি কথা স্বীকার করতেই হবে, খালেদা জিয়ার মতো একজন বড়মাপের নেত্রীর জন্য দলের নেতাকর্মীদের যে ধরনের জানবাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা তা তারা করতে পারেননি। কেন পারেননি সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা কৈফিয়ত হিসেবে সরকারের দমন-পীড়নের কথা বলে থাকেন। তবে রাজনীতি অভিজ্ঞমহলের বক্তব্য হলো, পৃথিবীতে বিরোধী দলের দাবি আদায়ের আন্দোলনে সরকারি বাধা আসেনি- এমন নজির নেই। তা সত্ত্বেও তারা মাঠে নামে, নামার চেষ্টা করে। কিন্তু বিএনপির কর্মকাণ্ডে মনে হয় না তারা মাঠে নামতে ইচ্ছুক। মাঠপর্যায়ের একজন বিএনপি নেতা আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠাতো, তাহলে দুই দিনেই গদি উল্টে যেত।’ তাহলে আপনারা পারেন না কেন?- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘কীভাবে পারব? আমাদের শীর্ষ নেতারা মাছ ধরবেন ঠিকই, তবে পানিতে নামবেন না। পাড়ে বসে বড়শিতে সব সময় মাছ ধরা যায় না।’

কথার যুক্তি অস্বীকার করা যাবে না। কেননা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, আইনি লড়াই করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। যারা বেগম জিয়ার মামলার আইনজীবী তারাও একই কথা বলছেন। তাদের এসব বক্তব্য তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, হতাশা ছড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তির দুটি পথ খোলা থাকে- এক. রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে চাপে ফেলে মুক্তি আদায়। দুই. সরকারের সঙ্গে এ প্রশ্নে একটি সমঝোতায় আসা। বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করেন, রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলা তাদের দলের পক্ষে এ মুহূর্তে অসম্ভব। দলের নেতৃত্ব সেভাবে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে পারছেন না। তাছাড়া এমন একজন নেতাও এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না, যিনি ডাক দিলে একযোগে নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসবেন। শীর্ষনেতাদের মধ্যে বিদ্যমান প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব নিয়ে গ্রুপিং-কোন্দল ও সমন্বয়হীনতা দলটিকে এমনই পর্যুদস্ত করেছে যে, কর্মীদের সামনে আশার প্রদীপ জ্বালানোর মতো অবিতর্কিত একজন নেতাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ফলে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর সেজন্যই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, উপায়ান্তর না দেখে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আপসের দিকেই যেতে পারে।

গত ২৯ জুলাই আমাদের সময় ‘বিএনপি নেতারা সরকারের ভরসায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছে- ‘বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক চেষ্টা করছেন না। তাদের কথা- নেত্রীকে মুক্ত করতে রাজপথে বড় ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন। সে কর্মসূচিতে থাকতে হবে সিনিয়র নেতাদের। অন্যদিকে সিনিয়র নেতারা বলছেন, সরকার না চাইলে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। আলোচনার পথ খোলা রেখে সরকারকে রাজি করাতে পারলেই খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।’ অপরদিকে একই দিন দৈনিক আমার সংবাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া যদি রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন, তাহলে সরকার তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে নমনীয় হতে পারে। পত্রিকাটি লিখেছে, সরকারের এ প্রস্তাবের পরই আবারো বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিছুদিন আগে আভাস দিয়েছিলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন প্যারোলে মুক্তি চাইলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা বিবেচনা করবে। যদি এ সমঝোতা সফল হয়, তাহলে স্বাস্থ্যগত কারণে বেগম জিয়া দ্রুতই প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। তবে বিষয়টি নিয়ে জটিলতাও রয়েছে।

বেগম জিয়া অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও সরকার যদি তাকে মুক্তি না দেয়, তাহলে কী হবে- এটা বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। তাই তারা ভালোভাবে আগপাছ ভেবে পা ফেলতে চাচ্ছেন, যাতে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে শেষে পস্তাতে না হয়। একই পত্রিকার ৪ আগস্ট সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সরকারের দেখানো পথেই মুক্তি মিলতে পারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। তিনি প্যারোলে জামিন নিয়ে বিদেশে না গেলে তার মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন দলটির নেতাদের একাংশ। তবে বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা বা প্যারোলে নেত্রীর মুক্তির ঘোর বিরোধী। তারা আন্দোলনের মাধ্যমেই আপসহীন নেত্রীকে মুক্ত করে আনার পক্ষে। এ বিষয়ে গত ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি হয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের নেত্রী জেলখানায় যাওয়ার পর আমরা এমন কোনো আন্দোলন করতে পারিনি যে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। আর আন্দোলনের কোনো আওয়াজও আমরা আদালতে দিতে পারিনি।’ অন্যদিকে যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তার মুক্তির জন্য বিকল্প রাস্তা খুঁজতে হবে।’ তবে সে বিকল্প রাস্তা সম্পর্কে তিনি খোলাসা করে কিছু বলেননি। সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে বলেছেন, বিএনপি জেগে উঠলে সরকার খালেদা জিয়াকে এমনিই ছেড়ে দেবে। তবে প্যারোলে মুক্তি নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ বেগম জিয়ার নিজের সিদ্ধান্তের বিষয় বলে তিনি মনে করেন। বেগম জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে তার দলের নেতাকর্মীরা কেন রাজপথে নেমে এলেন না বা আসতে পারলেন না তা একটি বড় প্রশ্ন। তিনি দলটির একচ্ছত্র নেতা। দলের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। কর্মীরা তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত; এমন একটি ধারণা অনেকেই পোষণ করেন।

তা সত্ত্বেও তার মুক্তির জন্য কার্যকর একটি আন্দোলন কেন দানা বেঁধে উঠল না- এ এক বিস্ময়! রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অবশ্য মনে করেন, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অদূরদর্শিতা এবং গাছাড়া ভাব বেগম জিয়ার বন্দিজীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ। বিএনপি এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দলটির সর্বত্র গ্রুপিং আর কোন্দল। এমন কোনো জেলা-উপজেলা নেই, যেখানে দুই বা ততোধিক গ্রুপের অস্তিত্ব নেই। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন স্তরে নিজেদের গ্রুপ সৃষ্টি করে রেখেছেন দলে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। ফলে নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে পারছেন না তারা।

চেয়ারপারসনের মুক্তি নিয়ে বিএনপি যে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আছে তা স্পষ্ট। আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তির আশা ছেড়ে দেওয়ার পর সামনে যে দুটি পথ খোলা আছে তাও সহজ নয়। কেননা সরকারকে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলা বিএনপির পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আবার রাজনৈতিক জীবনের বড় অর্জন আপসহীন উপাধি প্রশ্নবিদ্ধ হয়- এমন সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন কি-না, সে সন্দেহও রয়েছে। এদিকে তার অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন তার পরিবার। মুক্তি বিলম্বিত হলে তার জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে- এমনটিই বলছে বিএনপি। তাহলে কী আছে বেগম জিয়ার ভাগ্যে? কারাগারই কি হবে তার ঠিকানা? নাকি তিনি, তার দল ও পরিবার শেষ পর্যন্ত আপসের পথেই হাঁটতে শুরু করবেন? এ প্রশ্নের জবাব পেতে বোধকরি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads