• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
আমাদের চলচ্চিত্র ও একজন নায়করাজ

নায়করাজ রাজ্জাক

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

আমাদের চলচ্চিত্র ও একজন নায়করাজ

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ২১ আগস্ট ২০১৯

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তথা ’৪৭-এর দেশভাগের পর এদেশের চলচ্চিত্র জগতের উন্মেষকাল। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার রুপালি জগতের সূচনা ঘটে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ভেতরে বাঙালির নিজস্ব সত্তা বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্রকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো কিছুটা সময়। ষাটের দশকের শুরু থেকে এদেশে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। কিন্তু তখনো ভারতীয় বাংলা ছবির উত্তম-সুচিত্রার রসায়ন বাঙালিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নির্মিত চোখ ধাঁধানো ছবির কারিশমার কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে এদেশীয় চলচ্চিত্রের ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে কখনো লোকছবি, আবার কখনো উর্দু ছবিও নির্মাণে ব্যস্ত থেকেছেন নির্মাতারা। মাঝেমধ্যে সালাউদ্দিনের ধারাপাত, জহির রায়হানের কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল, সুভাষ দত্তের সুতরাং, কাগজের নৌকার মতো কিছু জীবননিষ্ঠ ছবির জয়জয়কার। কিন্তু তারপরেও এদেশীয় চলচ্চিত্রের কোথায় যেন একটা ঘাটতি রয়েই গিয়েছিল। সেই ঘাটতি পূরণে ওপার বাংলা তথা কলকাতা থেকে ১৯৬৪ সালে শরণার্থী হয়ে এদেশে এলেন আবদুর রাজ্জাক নামের একজন লোক। সংগ্রাম করে চলেছেন এদেশীয় চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পেতে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো ১৯৬৬ সালে। জহির রায়হানের লোকছবি বেহুলা লখিন্দরে খুঁজে পাওয়া গেল বাংলার চিরসবুজ নায়ক রাজ্জাককে। পরবর্তীকালে যিনি অধ্যবসায় আর নিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জন করেছেন নায়করাজের খেতাব। আজ ২১ আগস্ট তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

তার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তিনি ছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতার নায়ক। অন্যদিকে এদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান আরো বিশদ আকারে বলেন, ‘বোদ্ধা থেকে নিরক্ষর পর্যন্ত’ সবার নায়ক ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি। কেন তিনি জনমানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন? তার মৃত্যুতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা উল্লেখ করেছিল, নায়ক রাজ্জাকের কিছু ছবি হয়ে উঠেছিল ক্ল্যাসিক। হ্যাঁ, তিনি ক্ল্যাসিক কিছু চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন— আগুন নিয়ে খেলা, জীবন থেকে নেয়া, দর্পচূর্ণ, টাকা আনা পাই, পিতা পুত্র, মানুষের মন, রংবাজ, অতিথি, আলোর মিছিল, বাঁদী থেকে বেগম, কি যে করি, অনন্ত প্রেম, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, চন্দ্রনাথ, শুভদা, যোগাযোগ, বাবা কেন চাকর প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে। 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বরাবরই লাউড অ্যাক্টিংয়ে অভ্যস্ত। অনেকটা যাত্রাধর্মী। যে কারণে উচ্চশিক্ষিত বোদ্ধামহলের কাছে আমাদের চলচ্চিত্র খুব একটা আবেদন জাগাতে পারেনি। যেমনটি পেরেছিল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তথা কলকাতার বাংলা কিংবা মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবি। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে নায়করাজ এদেশের প্রচলিত লাউড অ্যাক্টিংয়ের সঙ্গে আন্ডার অ্যাক্টিংয়ের একটা যোগসূত্র স্থাপন করলেন। নির্মাণ করলেন অভিনয়ে স্বকীয়তা। পৌঁছে গেলেন জনমানুষের হূদয়ে। আর তাই উপরে উল্লেখিত প্রথিতযশা সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের উক্তিটি যথার্থ হিশেবেই প্রমাণিত হয়। উভয় বাংলার বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের পাতায় উত্তম-সুচিত্রার পর রাজ্জাক-কবরী স্মরণকালের সেরা জুটি হিশেবেই পরিগণিত হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালে নজরুল ইসলাম রাজ্জাক-কবরীকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘দর্পচূর্ণ’ ছবিটি। তিনপুরুষের জীবন আখ্যান এই ছবি। দাদা-বাবা-পুত্র— কেউ জানে না কার কী সম্পর্ক। অথচ একটি সময়ে এসে এরা পরস্পরের মুখোমুখি। নিজের অস্তিত্ব সংকটে দাঁড়িয়ে এরা সবাই। দাদা ফতেহ লোহানী বলছেন পৌত্র রাজ্জাককে, ‘ওরে শোন, শুনে যা’। পৌত্ররূপী রাজ্জাক বলছেন, ‘আজ আমার শোনার পালা শেষ, আজ আমার বলার পালা।’ সেই হূদয়ঘন সংলাপ উচ্চারণে নায়ক রাজ্জাকের সমস্ত শরীর অভিনয় করেছিল। ওই অভিনয় পারঙ্গমতা এরপর আমরা দেখে এসেছি বার বার। 

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘রংবাজ’ ছবির মাধ্যমে রাজ্জাক আমাদের চলচ্চিত্রে প্রথম অ্যান্টি হিরোর সার্থক রূপায়ণ দর্শকদের উপহার দেন। ‘অশিক্ষিত’র পাহারাদার, ‘ছুটির ঘণ্টা’র দপ্তরি, ‘কি যে করি’ ছবির পুরনো ঢাকার পতিতাপাড়ার দালাল মিথ্যা খুনি আসামির চরিত্র বাংলার সাধারণ দর্শকদের মন থেকে মুছে ফেলা সহজ হবে না। তেমনি ‘বাঁদী থেকে বেগম’-এর নবাব নওশের নায়করাজের অনবদ্য সৃষ্টি। আর শরৎকাহিনির সার্থক রূপায়ণ ‘চন্দ্রনাথ’ ও ‘শুভদা’ আটপৌরে বাঙালি সমাজের একজন হিশেবে গ্রহণ করে অভিনেতা রাজ্জাককে। নায়ক রাজ্জাক এভাবেই তার অভিনয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটান স্বমহিমায়।

মনের আরশিতে বন্দিদশা মানুষের শেকলের ঝনঝনানি শোনা যায়। সমৃদ্ধিশালী নগরের কাছে জ্বরা, তাপ, উল্লাস আর অহঙ্কারের আধুনিকতা ছায়া ফেলে ওই আরশিতে। আধুনিক জীবনের বিষফল, কাঁটাগুল্ম যে স্বাক্ষর রেখেছে জীবন নৌকায়, তারও ছায়া পড়ে ওই স্বচ্ছ জলের আরশিতে! একটা প্রলয়োল্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়না নিজেরই প্রতিবিম্বের কাছে। সে কখনো প্রতারণা করে না, বিপরীতে অসংখ্য প্রতারিত জীবনের ছায়া মেখে নেয় সে নিজের শরীরে। কুলকুচি সারতেই স্বচ্ছ জলের আয়নায় দেখা যায় কিছু বিশ্বস্ত দৃশ্য। ওখানেই গেঁথে যায় যূথবদ্ধ জীবনের কোলাজ। তাই মুখ দেখতে গিয়ে ‘স্বচ্ছ জলের নিচে আবিষ্কার হলো পরস্পরের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা আর বিদ্বেষ’। আবার ওখানেই জড়িয়ে ছিল অনুরাগমিশ্রিত ভালোবাসা। এ সবই ধরা পড়ে একজন রাজাধিরাজ রাজ্জাক অভিনীত ছবিগুলোর ভেতরে।

নায়ক রাজ্জাকের কিছু অসমাপ্ত চলচ্চিত্র রয়েছে, যার কাজ শুরু হয়েও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। সেরকম কিছু চলচ্চিত্র হচ্ছে অমানুষ, মুসাফির, সন্ধি বিচ্ছেদ, ফুলমতি, আমার তুমি, স্বর্গ, গ্রামের মেয়ে, বিধিলিপি। এই অসমাপ্ত ছবিগুলোকে নিয়ে কীর্তিমান এই অভিনেতার ওপর তৈরি হতে পারে এক অনবদ্য ডকুমেন্টারি। সে কথা তার মৃত্যুতে আমার অন্য একটি লেখায় বলেছিলাম। বিষয়টি আবারো ভেবে দেখতে বলব সংশ্লিষ্টজনদের। একই সঙ্গে বলব তার কিছু দুর্লভ চলচ্চিত্র রয়ে গেছে, যেগুলো দর্শক হিশেবে সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে না। সেরকম কিছু ছবি আগুন নিয়ে খেলা, যোগবিয়োগ, জীবনতৃষ্ণা, আঁকাবাঁকা, যাহা বলিব সত্য বলিব, ডাকপিয়ন, দুই পর্ব, চৌধুরীবাড়ি, অনুরোধ, উপহার ইত্যাদি। কেন তিনি একজন নায়ক থেকে অভিনেতা হয়ে উঠলেন— আগামী প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরতে এসব ছবি উন্মুক্ত করা উচিত। 

নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় যে ল্যাম্পপোস্টের নিচে থেকে এদেশে নায়ক রাজ্জাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই দুঃসময়কে তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। আর তাই আমরা দেখলাম, কীভাবে রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্সের লোগো হয়ে ওঠে ‘ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসা এক ছিন্নমূল মানুষ’-এর ছবি। ওই ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকে কপর্দকশূন্য যে মানুষটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে হঠাৎই তিনি থেমে গেলেন ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট, সন্ধ্যারাতেই। কিন্তু তার মার্জিত চেহারা, স্মিত হাসি, অসামান্য বাক্ভঙ্গি নায়করাজকে করেছিল অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আজ ওই মোহনীয় ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজয় স্বীকার করে চিরঋণী হয়ে রইল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads