• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

একটি ছাত্রীনিবাসের অমানবিকতা

  • আজহার মাহমুদ
  • প্রকাশিত ২৬ আগস্ট ২০১৯

বর্তমান সরকার নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে রয়েছে উপবৃত্তি, বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে এখন বাংলাদেশ একটি সুপরিচিত নাম। এখন পড়াশোনা করে নিজের ওপর নিজে নির্ভরশীল হতে চায় সবাই। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এখন অনেক এগিয়ে। সব স্থানেই মেয়েরা সমান পারদর্শী। তাই বাবা-মায়েরাও এখন ছেলেদের মতো মেয়েদেরও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পড়াশোনার শেষ স্তর পর্যন্ত এখন মেয়েরা পৌঁছে যাচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে।

কিন্তু এসব সাফল্যের পেছনে থাকে অনেক কষ্ট, অমানবিকতা এবং নির্যাতন। হয়তো মেয়ে বলেই এমনটা সম্ভব। উচ্চশিক্ষার জন্য একটি মেয়ে পরিবার-স্বজন রেখে অচেনা শহরে এসে স্থান খুঁজে নেয় হোস্টেলে। আমাদের শহর চট্টগ্রামেও এখন এমন অনেক ছাত্রী হোস্টেল রয়েছে। পরিবারের সদস্যরাও এখন মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য হোস্টেলে রেখে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যায়। কারণ এখানে তারা ভালো থাকবে। তাই অধিকাংশ মেয়েরাই হোস্টেলে থাকে, শুধু পড়ালেখার জন্য।

তবে এ কথা সত্য, আমাদের সমাজে একটা ছেলে যা করে, একটা মেয়ে তা করতে পারে না। যেমন আমার হোস্টেলের খাবার ভালো লাগল না, আমি হোটেলে গিয়ে খেয়ে এলাম। আমার ক্ষুধা লাগল, আমি নাস্তা করে এলাম। আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে আমি চা খেয়ে এলাম। কিন্তু একটা মেয়ে হলে? আমাদের এ সমাজে সেটা অনেক কিছু হয়ে যাবে। একটা মেয়ে হোটেলে বসে চা খেলে পুরো হোটেলের মানুষ তার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। আর কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ পরিবেশটাকে আরো নোংরা করে তোলে।

যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরো পৃথিবীটাই অনিরাপদ। তবু এসব ছাত্রী যখন হোস্টেলে থাকে, তখন বাবা-মাও একটু নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু এসব নিরাপদ হোস্টেলেও যখন চলে অন্যায় আর নির্যাতনের মতো কার্যকলাপ, তখন বাকশক্তিটাও হারিয়ে ফেলি। এক দিন আগের বাসি নষ্ট ছোলা দিয়ে পরেরদিন সকালেও যখন নাস্তা করতে হয় হোস্টেলের ছাত্রীদের, তখন বলতে ইচ্ছে করে হে মানবতা, তুমি কি সত্যিই হারিয়ে গেছ? হ্যাঁ, এমনও অমানবিক কাজ করা হয় এখনকার হোস্টেলগুলোতে। চট্টগ্রাম নগরীর একটি ছাত্রীনিবাসের বিরুদ্ধে সম্প্রতি এমন অভিযোগ ওঠে। অথচ এসব ছাত্রীর অভিভাবক মাসের শুরুতেই ৪ হাজার ৮০০ টাকা করে দিয়ে যান। বিনিময়ে তাদের সন্তানরা পাবে দুই বেলা ভাত, এক বেলা নাস্তা। আসলে এখন ছাত্রীনিবাস কিংবা ছাত্রনিবাস বলতে কিছু নেই। সবকিছুই এখন মানুষের টাকা মেরে খাওয়ার ফন্দি।

শুধু যে সকালের নাস্তা তা নয়, অনেক সময় দুপুরের খাবার কিংবা রাতের খাবারেও এমন অমানবিক কাজ করে হোস্টেলটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানায়, তারা যখন এ বিষয়ে হোস্টেল সুপারকে নালিশ দেয়, তখন হোস্টেল সুপার তাদের জবাব দেয়, ভালো না লাগলে চলে যাও। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এই অনৈতিক কাজের সঙ্গে হোস্টেল কর্তৃপক্ষে আপাদমস্তক সবাই জড়িত। ভাগবাটোয়ারার হিসাবটা সমানভাবেই সবাই পায়।

এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, এখন মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই। মানবতা তো দূরের বিষয়। আমরা এখন মানুষকে তার ন্যায্য পাওনাটাই দিই না। তবু বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে এসব ছাত্রীকে। কারণ পড়ালেখা আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত সুবিধা আছে বলে। অনেক ছাত্রী খেয়ে না খেয়ে একমাত্র স্বপ্ন পূরণের জন্য থেকে যাচ্ছে এমন নির্মম পরিস্থিতিতেও। এই কষ্ট আর নির্মমতার পরও একদিন এসব ছাত্রী সফলতার চূড়ায় উঠবে। যদি তাদের একটু সুন্দর পরিবেশ এবং ভালো খাবার দিয়ে আরো ভালো রাখত এ সমাজ, তাহলে হয়তো তারা পুরো বিশ্ব জয় করত। হয়তো মেয়ে বলে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু যারা এসব অন্যায় করছেন তাদের শাস্তি প্রাপ্য। এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সমাজের উচ্চ মহলের এবং অভিভাবকদের সজাগ হতে হবে। নাহলে এভাবেই অপরাধগুলো বড় হতে থাকবে। তাই সময় থাকতে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে আপনার, আমার— সবার। প্রশাসনের সুদৃষ্টি জরুরি বলেই মনে করি।

জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ব সভ্যতার অংশ বলে নিজেদের দাবি করি। কিন্তু আমরা ভেবে দেখেছি কি—সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির যে বিষবাষ্প আমরা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছি—সেই অনলে পুড়ছে আমাদেরই সন্তানেরা, আমাদের ভবিষ্যৎ। সুনীতি ও সুবোধ এখনো যদি আমাদের বিবেককে জাগ্রত না করতে পারে, তবে আমাদেরও বলতে হবে একদিন—রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads