• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ইতিহাস না জেনে কথা বলা

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

ইতিহাস না জেনে কথা বলা

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল, যা প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সরকারি নির্যাতন, প্রতিপক্ষের শত্রুতা ও বিরোধিতা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও বিভিন্ন সময়ের ভাঙনসহ নানামুখী প্রতিকূলতা কাটিয়ে আজ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে নিজের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে দলটি ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশে সরকার গঠন করেছে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সরকার গঠন করেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আন্দোলনসহ বিভিন্ন কৌশলে আওয়ামী লীগ জনগণের মাঝে ফিরে এসেছে এবং নতুন পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখেছে। এভাবে আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়াটাও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ছিল বিরাট এক সাফল্য। পরবর্তীকালে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর।

এ পর্যন্ত এসে নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠকরা বিভ্রান্ত হতেই পারেন। আমার উদ্দেশ্য আসলে এমন দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করা, যেগুলো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ইতিহাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঠিক রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ চিন্তা ও সিদ্ধান্তের পেছনেও বিশেষ কারণ রয়েছে। এবারের আগস্ট মাসে এমন অনেকেও আওয়ামী লীগের ইতিহাস শুনিয়েছেন, যারা নিজেরাই সঠিক ইতিহাস জানেন কি-না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেমন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা বলেছেন, ‘যদি ইতিহাস দেখি তাহলে দেখবো, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শহীদ সরোয়ার্দী (সোহরাওয়ার্দী নয়) এবং শামসুল হক সাহেবের দ্বারা।’ এর আগে-পরে ‘চোরের দল’, ‘চাটার দল’ এবং ‘বাকশাল’সহ আরো কিছু বক্তব্যের মাধ্যমে ‘মরহুম’ শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের অনেকেরই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল না। ‘অনেকেই’ পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন!

অন্য আরো কিছু কথা বললেও ওই নেতার প্রধান উদ্দেশ্য গোপন থাকেনি। তিনি আসলে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন। অথচ সত্য হলো, বঙ্গবন্ধু নিজেও কিন্তু কখনো বলেননি যে, তিনিই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আগ্রহী পাঠকরা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামের গ্রন্থ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। দুটি গ্রন্থেই বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকলেও গঠন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় তার পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ, আগে থেকেই তিনি কারাগারে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। একই কারণে অস্বীকার করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানিত করার চেষ্টাও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

কথাটার অর্থ আবার এটাও নয় যে, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শহীদ সরোয়ার্দী এবং শামসুল হক সাহেবের দ্বারা।’ বাস্তবে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। জন্মগতভাবে সিরাজগঞ্জের সন্তান হলেও মওলানা ভাসানীকে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশ থেকে বার বার বহিষ্কৃত ও বিতাড়িত হতে হয়েছিল। একজন নেতা হিসেবে তাঁর উত্থান ঘটেছিল বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশ আসামে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, মওলানা ভাসানী তখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। সিলেটকে পাকিস্তানের তথা বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা ছিল মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক অবদান।

পাকিস্তান হওয়ার পর পর স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং প্রথম ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ চলে গিয়েছিল গণবিচ্ছিন্ন কুচক্রী নেতাদের দখলে। কুচক্রী নেতারা মুসলিম লীগকে এমনভাবেই কুক্ষিগত করেছিলেন যে, সাধারণ মানুষ দূরে থাকুক, এমনকি মওলানা ভাসানীর মতো একজন প্রধান নেতাকেও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ দেওয়া হয়নি। সে অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে একদলীয় স্বৈরশাসনের সূচনা ঘটেছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকরা বাধাহীনভাবে পূর্ব পাকিস্তানবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। পরিণামে স্বায়ত্তশাসনসহ ন্যায়সঙ্গত সব অধিকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) বঞ্চিত হয়েছে। সে পরিস্থিতিতে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেন মওলানা ভাসানী। পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রদেশজুড়ে বিকাশমান অসন্তোষ এবং বিচ্ছিন্নভাবে চলমান বিভিন্ন আন্দোলনকে সমন্বিত করার মাধ্যমে বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী এক ‘রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন’ আহ্বান করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরনো ঢাকার ‘রোজ গার্ডেনে’ অনুষ্ঠিত এই কর্মী সম্মেলনেই গঠিত হয়েছিল প্রদেশের প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। দলের ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটিতে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, আতাউর রহমান খানসহ তিনজনকে সহ-সভাপতি, টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, বন্দি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করা হয়েছিল।

তথ্যনির্ভর ইতিহাসের আলোকে এখানে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রসঙ্গের উল্লেখ করা দরকার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মওলানা ভাসানীর নাম এড়িয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সামনে আনা হলেও ১৯৪৯ সালের মার্চে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে চলে আসার পর অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান ক্ষেত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। বিভিন্ন মামলা পরিচালনা উপলক্ষে মাঝে-মধ্যে ঢাকায় এলেও এবং কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানে কোনো দল গঠনের উদ্যোগ নেননি। আওয়ামী মুসলিম লীগেও তিনি প্রথম সুযোগেই যোগ দেননি।

মুসলিম লীগে সুযোগ না পাওয়াসহ ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী নতুন একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন সমমনা নেতার সঙ্গে যৌথভাবে রাজধানী করাচিতে এক রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ‘অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে স্বতন্ত্র একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (অথচ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন)। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও প্রধান সংগঠক এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা আবদুস সাত্তার নিয়াজিকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর ব্যস্ততা বেড়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের তথা কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। সে পর্যায়ে তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতা মানকি শরীফের পীরের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং ১৯৫০ সালে মামদোতের নবাবের নেতৃত্বে গঠিত ‘জিন্নাহ মুসলিম লীগ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। শহীদ সোওরাওয়ার্দীর উদ্যোগে তার নিজের নেতৃত্বাধীন ‘অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের’ সঙ্গে দল দুটি একীভূত হয় এবং তিন দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় নতুন দল ‘অল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ (২৪ জানুয়ারি ১৯৫১)। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন অল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল আরো পরে— ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে। এর আগে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে লাহোরে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এক কনভেনশনের মাধ্যমে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানী কারাগারে থাকায় ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারেনি। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী মুক্তি পাওয়ার পরপর ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দলের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে বছরের ৯ জুলাই ঢাকার ‘মুকুল’ সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সিদ্ধান্তটি অনুমোদন লাভ করে। উল্লেখ্য, এই কাউন্সিল অধিবেশনের এক প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি জানানো হয়েছিল। এখানে বলা দরকার, দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশন থেকে দলটি ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামে কার্যক্রম শুরু করেছিল।

এভাবে তথ্যনির্ভর যে কোনো পর্যালোচনায় এ তথ্যই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, অন্য কোনো নেতা নন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৩ এবং ১৯৫৫ সালের পর ১৯৫৬ সালের ১৯-২০ মে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনেও মওলানা ভাসানীকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, প্রধানত স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে মতানৈক্যের কারণে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ২৪ জুলাই নিজের প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং ২৫ জুলাই গঠন করেন নতুন দল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (ন্যাপ)। ন্যাপের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় শাখার সভাপতি পদে মওলানা ভাসানীকে নির্বাচিত করা হয়।

উপরে সংক্ষেপে বর্ণিত ঘটনাবলির ভিত্তিতে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। সুতরাং অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানিত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানীকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। একই কারণে ইতিহাস না জেনে কোনো মন্তব্য করাও অনুচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads