• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

ছাত্ররাজনীতি কি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বে ব্যর্থ

  • প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শাহ লোকমান চৌধুরী

 

 

বাংলাদেশ নামটার সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন প্রত্যেকটি জায়গায় আছে ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস। জনগণের প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেত ছাত্র আন্দোলনে। ষাটের দশক, সত্তরের দশক এবং আশির দশকেও ছিল ছাত্ররাজনীতির গৌরবগাথা। সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতি তার প্রভাব রেখেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন তারা কেন ছাত্রদের অধিকার আদায়ে প্রভাব রাখতে পারছে না? ক্ষমতার লোভ-ই ছাত্ররাজনীতির কাল হলো!

নব্বইয়-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। যেখানে নব্বইয়ের আগে অধিকারের প্রশ্নে সব ছাত্র সংগঠন বারবার একজোট হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, সেখানে নব্বই-পরবর্তী সময়ে তারা একবারও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি যার অন্যতম কারণ তাদের অভিভাবক রাজনৈতিক দলের আনুগত্য। সেই লেজুড়বৃত্তিক আনুগত্যের শেকল থেকে বেরিয়ে অধিকারের দাবিতে এক হতে পারেনি। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বারবার নিজেদের মধ্যে কোন্দল আর হানাহানি নিয়ে ব্যস্ত থাকা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতায় ছাত্ররাজনীতি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। এখন অনেকেই প্রশ্ন তোলেন ছাত্ররাজনীতির আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি না? দেশের মেধাবী তরুণ সমাজ রাজনীতিবিমুখ। কারণ যখন তারা তাদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংগঠনগুলোকে পায় না তখন তারা বিকল্প ভাবতে থাকে।

বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হতে হবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়া। আমাদের দেশে নেতৃত্ব বলতে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝানো হয়। কিন্তু এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, খেলোয়াড়; এমনকি একজন অভিনেতা-অভিনেত্রী— সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতা এবং এসব ক্ষেত্রে নেতা তৈরির কাজটি ছাত্ররাজনীতিকদের করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে পৃথিবী যেখানে যাচ্ছে, ছাত্রদের তাদের দেশের তরুণ সমাজকে সেখানেই নিতে হবে। যেমন, আমরা যদি একটু লক্ষ করি, তবে দেখব, স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালই ছাত্র নেতৃত্বের গুণাবলি আয়ত্ত করেছিলেন বিধায় সে সময় বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবল, ষাটের বা সত্তরের দশকের পপ গান এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা তার হাত ধরেই হয়েছিল। খেলায় আবাহনী এ দেশে প্রথম আধুনিকতা আনে। আবার সংগীতে আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদকে তিনিই পেট্রোনাইজ করেন। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের তরুণ সমাজকে উন্নত পৃথিবীর সমানতালে পা ফেলার কাজটি ছাত্র নেতৃত্বের ভেতর দিয়েই আসবে। আজকের ছাত্র সংগঠনগুলো এভাবে অনেক কাজ করতে পারে। যেমন দেশ এখন ভয়াবহভাবে সংস্কৃতির সংকটে ভুগছে। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো এই সংকট থেকে কিশোর ও তরুণদের বের করে আনতে পারে। প্রতিটি স্কুলে তারা সাংস্কৃতিক সংগঠন করতে পারে, সেখানে নিজস্ব উদ্যোগে আধুনিক যন্ত্রপাতি জোগাড় করে বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সংস্কৃতি ও বাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যদি ছাত্র সংগঠনগুলো সততার সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজ করে তাহলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যে সংস্কৃতির সংকট চলছে সেখান থেকে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ তৈরি করতে পারবে সাংস্কৃতিক অনেক নেতা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একদেশদর্শী নেতৃত্বই আজকের ছাত্ররাজনীতিকে পথভ্রষ্ট করে তুলেছে।

কিছুদিন আগেও যখন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হলো তখনো সব ছাত্র সংগঠন এক হতে পারেনি, কিংবা কোটা সংস্কারের মতো শিক্ষার্থী সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনেও সব ছাত্র সংগঠন এক হতে পারেনি। যেখানে এসব আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেখানে তারা লেজুড়বৃত্তি থেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে সাধারণ ছাত্ররাই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে এবং ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের গুরুত্ব হারিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা হারিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রমশই নিজেদের ছাত্রসম্পৃক্ততা থেকে দূরে নিয়ে গেছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়ে প্রতিনিধিত্বের জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছে তারা এখন। বর্তমানে তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। ছাত্ররাজনীতি তার লেজুড়বৃত্তির কারণে ধীরে ধীরে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। এর থেকে উত্তরণেও এখন রাজনৈতিক দলগুলোকেও ভাবতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads