• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পেঁয়াজে যন্ত্রণাকর ঝাঁজ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

পেঁয়াজে যন্ত্রণাকর ঝাঁজ

  • বিশ্বজিত রায়
  • প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০১৯

নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারের তালিকায় যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে, তার মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। ঝাঁজ জাতীয় এ কাঁচা পণ্যটি না হলে সদাইয়ের থলেটি পুরোই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর এটি না হলে ঘরণীর পেঁয়াজহীন ঝাঁজে গৃহকর্তার ঘরে থাকাই দায়। কারণ মাছ-মাংস ও ভর্তাসহ তরিতরকারি রান্নায় পেঁয়াজের স্থান সবার উপরে হওয়ায় গৃহিণীর কাছে পেঁয়াজের গুরুত্ব সবসময়ই বেশি। আর গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্যের মূল্য ঝাঁজে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বাজার। হঠাৎ একলাফে পেঁয়াজের দাম দুই থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বরাবরই নাজেহাল হতে হচ্ছে মানুষকে। এরই মধ্যে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছে। গত সপ্তাহ দশদিন ধরে পেঁয়াজের বাজারে এ অবস্থা চলতে থাকার মূল কারণ বের করা প্রয়োজন।

পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীলতার এ মুহূর্তে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। পেঁয়াজের ঝাঁজে বাংলাদেশ যখন নাকাল, তখন ভারতের এ সিদ্ধান্ত মুনাফাভোগীদের অবৈধ অর্জনের পথ আরো প্রসারিত করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে এমনটি প্রতীয়মান হয়। খবরে বলা হয়, কোনো কোনো দোকানে পেঁয়াজের বস্তা প্রায় ছাদ ছুঁয়েছে। সব আড়তে বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরও এদিন হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ১৪টি ট্রাকে পেঁয়াজ দেশে এনেছেন ব্যবসায়ীরা, যাতে ছিল ২৬৮ টন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯টি ট্রাকে ৪৩৭ টন ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে ঢোকে শুধু হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। আবার ৩০ সেপ্টেম্বর এক দিনেই টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ ঢুকেছে রেকর্ড পরিমাণ ৫৩৬ টন। এসব পেঁয়াজ ট্রাকে করে সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আগের দিন কনটেইনারে দুই চালানে আসে মিয়ানমারের ১৭৪ টন পেঁয়াজ। একই সময়ে খালাস হয়েছে মিসর থেকে আসা ১৪৫ টন।

খবরে জানা যায়, বাংলাদেশে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে ২৩ লাখ ৭০ হাজার টন উৎপাদিত হয়। এর ৩০ শতাংশ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ রয়েছে ১৬ লাখ ৩১ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩১ হাজার টন পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে দেশে এসেছে ১০ লাখ ৯১ হাজার টন। এ হিসাবে চাহিদার চেয়ে মজুত অনেক বেশি রয়েছে। সরকারও বলেছে, এখনো প্রায় তিন লাখ টন পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে মজুত আছে, যা দিয়ে আগামী ৫০ থেকে ৫৫ দিন দেশের পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো সম্ভব। আর এ সময়ের মধ্যে আমদানি করা প্রচুর পেঁয়াজ দেশে ঢুকবে [সূত্র : কালের কণ্ঠ]। আর তারই ফলস্বরূপ গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি (দেশি ও আমদানি) পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় উঠেছে বলে জানা গেছে। এর পরের দিনের খবরে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪০-৪৫ টাকা। সরবরাহ কম থাকার অজুহাত দেখিয়ে খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছেন দাম রাখছেন। ওইদিন কোথাও কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ১১০ টাকা, কোথাও ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

গত দশ-পনেরো দিন ধরে পেঁয়াজের বাজারে দাম বৃদ্ধির যে লুকোচুরি খেলা চলছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। অথচ পত্রিকার খবর অনুযায়ী দেশে দেদার পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে মিয়ানমান, মিসর ও তুরস্ক থেকে। অথচ ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানিতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলেই এসব অবৈধ আড়তদার ভোক্তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার বনোল্লাসে মেতে ওঠে। এই অপতৎপরতা আমাদের চিরাচরিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধিতে কথা বলতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত বাজারের সুবিধাটা ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন। যদি নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা থাকত, তাহলে ব্যবসায়ীরা এভাবে রাতারাতি অতি মুনাফার প্রতিযোগিতায় নামতেন না। কারণ কত টাকার পেঁয়াজ কত টাকায় বিক্রি হবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা থাকে না। উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যেও সমন্বয় করা হয় না। তবে বাড়তি দামের এ সুবিধা কিন্তু কৃষক পায় না। সবটাই পকেটে পুরছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাও আবার একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, যেখানে ক্রেতারা অসহায়’ [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০১.১০.১৯]।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা আসলে নতুন কিছু নয়। এটা আমাদের চলমান বাস্তবতা। আজ পেঁয়াজের দামে যে মূল্য কারসাজি চলছে, কাল হয়তো রসুনের দরে দেখা দেবে নৈরাজ্যকর নতুন খেলা। পরশু আলু, তরশু কাঁচামরিচের ঝালে হাঁফিয়ে উঠবে ক্রেতাসাধারণ। পরের দিন ডাল, তেল, চালের মূল্য সংকটে নাকাল হবে দেশ। এর রেশ কাটতে না কাটতেই মাছ, মাংস, সবজিসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামে অসন্তুষ্টি দানা বাঁধবে। এভাবে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা লুটে নিচ্ছে অবৈধ মুনাফাভোগীরা। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত মূল্য হাঁকানোর মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার চেষ্টা করছে। মূল্য বৃদ্ধির এই অনৈতিক চাপে পিষ্ট হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। মূল্য মুমূর্ষু মানুষের পকেট কানা করে এই ফায়দা হাসিলের চেষ্টা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ভেবেচিন্তেই এমনটা করছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এ ঘোষণার পর উল্টো পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এতে বোঝা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা জেনেও না জানার ভান করে এদের মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ সুযোগে একটা শ্রেণি অঢেল অর্থের মালিক বনে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভোক্তাশ্রেণি বার বার প্রতারিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংস্থা ক্যাব জানিয়েছে, ‘পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেভাবে কাজ করেনি। তাই মিয়ানমারের পেঁয়াজও মাত্রাতিরিক্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। যথাযথভাবে মনিটর করা হলে এ অন্যায় করার সাহস পেত না কেউই। চিন্তা করতে পারত না ভোক্তার পকেট কেটে অতিরিক্ত মুনাফা করারও’ [সূত্র : সমকাল, ২৪.০৯.২০১৯]। এ থেকে পরিত্রাণ দরকার। অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য জীবন পরিচালনা করা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়বে।

জীবন-জীবিকার জন্য ব্যবসা বৈধ ও উত্তম পন্থা। সৎভাবে জীবিকা নির্বাহের বৃহৎ একটি মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসা। পুঁজির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে লাভের ন্যায্যতা বের করে আনাই ব্যবসার মূল লক্ষ্য। কিন্তু সেই লক্ষ্য পদপিষ্ট করে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ লুটেরা নীতি গ্রহণ করে চলেছে। আমাদের দেশে মূল্য বৃদ্ধির অনৈতিক প্রতিযোগিতা যেভাবে চলছে, অন্য কোনো দেশে এর ছিটেফোঁটা আছে বলে মনে হয় না। যতটুকু জানা যায়, অন্য দেশে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়লে সেখানেও তার দাম বাড়ে। আবার মূল্য কমে এলে স্বাভাবিকভাবেই তা কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সেটা কমার লক্ষণ খুবই ক্ষীণ, যা আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অবৈধ অনৈতিক কর্মকাণ্ড আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। আমরা সর্বদা সুযোগ খুঁজি বেড়াই, কখন কোন পণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের বারোটা বাজানো যায়। এই মনোবৃত্তি থেকে বের হতে পারছে না একশ্রেণির প্রতারক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানহীন এসব মুনাফা-মোহগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনার সক্ষমতা দেখাতে পারছে না রাষ্ট্র। যে কারণে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি।

জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকলে দাম কমবেশি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। প্রায় সব দেশের বাজারে এমনটি ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের বাজারব্যবস্থায় শুধু বাড়েই না, অবৈধ ব্যবসায়ীরা এতটাই প্রবল যে ভোক্তাপ্রাণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। নীতিনৈতিকতাকে তুড়ি মেরে সর্বদাই অবৈধ অগ্রহণযোগ্য উপায় অবলম্বন করছে তারা; যেখানে দেশ ও সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে নিজেদের অবৈধ অর্থ কামানোর কথাই সর্বদা ভাবা হয়। পেঁয়াজের বর্তমান বাজার দেখে মনে হচ্ছে— পেঁয়াজে যন্ত্রণাকর ঝাঁজ, মুনাফা আদায়ই আসল কাজ। এ নীতিভ্রষ্ট বাস্তবতা আমাদের স্বভাব চরিত্রে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। সাধারণ মানুষকে এই মুনাফাভোগীদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

bishwa85@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads