• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

শিশুশ্রম প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা

  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৯

আল-মাহমুদ

 

 

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সময়ে প্রায়ই ফেসবুক ও ইউটিউবে শিশু নির্যাতনের ভিডিও দেখা যায়। শিহরিত হয়ে ওঠার মতো কত নির্মম, অমানবিক ও নিষ্ঠুর সেই ভিডিও চিত্র! শিশুদের অনেকেই পরিবার হারিয়ে কেউবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গ্রামে কিংবা শহরে এসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুতে পরিণত হয়। চরম দরিদ্রতায় বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে শিশুশ্রমকে বেছে নেয় তারা। এ ছাড়া তাদের আর উপায়ও থাকে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের অনেকে শ্রম দিয়েও যথাযথ পারিশ্রমিক পায় না, যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। অধিকাংশ শিশুই আবার কর্মস্থলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এরূপ বিষাক্ত শিশুশ্রম থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে  রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের পরিবার, সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রেরও। এরূপ শিশুশ্রমের কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে শিশুশ্রমের কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ, পরিবারের সামর্থ্যহীনতা। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র। অর্থের অভাবে ও পারিবারিক সচ্ছলতার জন্য পিতামাতা তাদের সন্তানকে কাজে পাঠায়। শিশুশ্রমিকের প্রায় অর্ধেক শিশুই সামর্থ্যহীনতার কারণে বিদ্যালয়ে যায় না। এ ছাড়া শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা, পিতামাতার অনীহা এবং বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়াও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই শিশুদের একটি বড় অংশ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। তাদের বাস, ট্রাক, ছোট্ট যানবাহনের হেলপারি, কেউ চায়ের দোকানে, কেউ হোটেল রেস্তোরাঁয়, কেউবা আবার মোটরগাড়ি ও রিকশা গ্যারেজে, এমনকি ইটভাটাসহ ছোট ছোট কারখানায় কাজ করছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে শিশুশ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কারখানার মালিক বা ব্যক্তি এর এক ভাগও মানে না। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু, যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে, তবে সেটা অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি ঝুঁকিহীন কাজও করে তবে সেটা শিশুশ্রম। যেটা অনুমোদন যোগ্য নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ কলকারখানা এমনকি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রমিক চোখে পড়ার মতো। যাদের সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হয়, এমনকি সারা সপ্তাহে একটুও অবকাশ দেওয়া হয় না। তথ্যমতে, ৮৫ শতাংশ শিশু বড়দের মতো পূর্ণকালীন কাজ করে—এমন শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ২৯ লাখ। শিশুদের মধ্যে ৫ বছর বয়সী কিংবা এর ছোটরাও রয়েছে, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। আবার ২৯ লাখের মধ্যে মজুরি পায় না ১৬ লাখেরও বেশি শিশু। তারা শুধু থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করে।

তথ্যমতে, কর্মজীবী শিশুদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই স্কুলে যায় না। তাদের মধ্যে আগে স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না এমন শিশুর সংখ্যা ২১ লাখ। আর মাত্র ১০ লাখ শিশু পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে। তবে পৌনে ৩ লাখ শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগই পায়নি। একটি জাতির কর্ণধার আজকের শিশু তথা আগামী প্রজন্ম। তাদের এমন অমানবিক ও নিষ্ঠুর অবস্থা দেশের জন্য মহাঅভিশাপ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম নিয়ে দেখা স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে যাবে, বাস্তবে পরিণত হবে না।

তাই শিশুশ্রম প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উদ্যোগও এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। শিশুশ্রম থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে পরিবার। আমাদের পরিবারে থাকা প্রতিটি শিশুকে আগামী দিনের কর্ণধার ভেবে সঠিকভাবে লালন করা আমাদের দায়িত্ব। তাদের ওপর নির্ভর না করে বরং তাদের সুন্দর শৈশব দেওয়াই আমাদের কর্তব্য। সামাজিকভাবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পথশিশুদের শিক্ষাদান ও আত্মোন্নয়নমূলক শিক্ষা দিতে হবে। যেখানেই আমাদের শিশু নির্যাতন হবে, সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে সেখানেই রুখে দাঁড়াতে হবে।

এ ছাড়া শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে রাষ্ট্র। শিশুশ্রম বন্ধে নীতি-নির্ধারকদের শুধু কাগজে-কলমে ভূমিকা পালন করলে চলবে না। বরং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবমুখী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শিশু নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অবস্থান নিতে হবে। তা ছাড়া অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। আর এ কাজে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা

    

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads