ফেসবুক মাধ্যমটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষ এ থেকে উপকারও পাচ্ছে। অনেক সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে দ্রুত। ব্যবসায়িক কাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বাড়ি বসেই আয় করছে কেউ কেউ। কাজ সহজতর হয়েছে বিজ্ঞাপনের। বিস্ময়করভাবে বেড়েছে সামাজিক ভালো কাজ। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগকে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে একেবারে তৃণমূলের মানুষের কাছে। বড় বড় রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসছে অনেক মানুষ শুধু একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমেই।
কিন্তু কিছু মানুষ এই ফেসবুকের যে ব্যবহার করছে তাতে যন্ত্রণার বড় কারণ হয়ে উঠছে দিন দিন। গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাণ দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকেও, ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয় অপপ্রচার আর সংঘাতের সৃষ্টি করে দেশকে করার চেষ্টা চলছে অপ্রস্তুত! তবে এখন ব্যাপ্তি যেহেতু বেড়েছে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের যেহেতু থাকতেই হবে সেহেতু ফেসবুকসহ সব সামাজিক মাধ্যম নিয়েই ভাবতে হবে আরো বিস্তরভাবে। এ ভাবনায় জনসাধারণ এবং সরকার উভয় পক্ষের একত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। একদিকে যেমন আইনের বড় একটি প্রায়োগিক ব্যাপার থাকতে হবে, তেমনি আবার ব্যবহারবিষয়ক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও সরকারের ভাবনায় রাখতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারী আছে যারা এর আইনকানুন বা ব্যবহারবিধি জানে না। তারা যে কোনো ধরনের একটি পোস্ট দেখলেই খুব বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। এতে করে নিজের অজান্তেই হয়ে পড়ে এক ধরনের সামাজিক অপরাধী।
কিছুদিন আগে বসে ছিলাম একজন প্রবীণ মানুষের সঙ্গে। তিনি ফেসবুক ব্যবহার করছেন কিছুদিন যাবৎ। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলাম তিনি কী কী ধরনের সংবাদ পড়ছেন। তাতে তার ফেসবুকে বেশিরভাগই দেখা গেল বিভিন্ন সংবাদের পেজে লাইক দেওয়া রয়েছে। কথা বললাম। তিনি বললেন সংবাদ দেখার জন্যই তিনি ফেসবুক ব্যবহার করেন। দেখে ভালো লাগল।
আবার এমন অনেক অভিযোগও শুনতে হয় নারীদের কাছ থেকে যে, তাদের মেসেঞ্জারে বিরক্তির শিকার হতে হয়। একজন গৃহিণীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন এমনও ইউজার আছে যারা নিজেদের উদাম গায়ের ছবি রাত হলেই পাঠাতে থাকে। শুধু তাই নয়, ভিডিও কল দিয়ে বসে থাকে যে কোনো সময়। এদের ব্লক করেও রেহাই নেই। অন্য আইডি থেকে আবার রিকোয়েস্ট পাঠায়!
এ বিষয়গুলোতে এখনো আমরা সচেতন করতে পারিনি, আর এ কারণেই সাবধান হয়নি। এর সঙ্গে তো বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ব্যাপার আছেই। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে ফাটলের কারণে অনেক সংসারও ভাঙছে, বেড়েছে পরকীয়ার হারও। সামাজিক অপরাধ বাড়ার পেছনেও তাহলে এই ফেসবুকের একটা ভূমিকা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের ফেসবুক ওয়ালগুলোতেও বিভিন্ন তথ্য সম্পন্ন পেজে লাইক দেওয়া থাকে। কিন্তু তারপরও দেখা যায় সাজেস্টেড অনেক পেজের খবর চলে আসে। কিছুদিন আগে এক সাজেস্টেড পেজে দেখলাম ধর্মকে অবমাননার তথ্য ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ যারা প্রথম দেখে তারা দেখেই ভেবে নেয় এটা বুঝি সত্য এবং তা থেকেই তারা শেয়ার করে ফেলে। আর এভাবেই এক সময় সৃষ্টি হয়ে যায় গুজবের। গুজবের নামে যা হচ্ছে তা অনেকটা এই বেশি রিঅ্যাক্ট করা থেকেই এবং আরেকটি হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে এরা চায়ই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে ।
ফেসবুক আইডি হ্যাক হলে যখনই কেউ এ বিষয়ে জিডি করবে তখনই দ্রুত পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম অথরিটি তাদের পেজে জানিয়ে দিতে পারে যে এই আইডি হ্যাক হয়েছে, তাহলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল অনেকটা কমে যাবে। এ বিষয়টি যে থানায় জিডি করবে তারাও প্রেস ব্রিফিং করে প্রকাশ করতে পারে। একেবারে যারা না বুঝেই এ মাধ্যম চালাচ্ছে তাদেরও ফেসবুক ব্যবহার ও এর পোস্টের বিভিন্ন মতামতের ব্যাপারে ও আইন প্রসঙ্গে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কোন বিষয়গুলো ফেক ও বানানো সে বিষয়ে সবার একটি ধারণা থাকা প্রয়োজন। কোন বিষয়গুলো শেয়ার করা যাবে না সে বিষয়েই সম্যক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিষয়ে আরো সচেতনতা প্রয়োজন রয়েছে। আইনের ধারাগুলো বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ সংক্রান্ত ধারাগুলো প্রচার করা দরকার।
একটি ফেসবুক হেল্প সেন্টারও চালু করা যেতে পারে। এতে করে তাৎক্ষণিক ফেসবুক সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পেতে পারে জনসাধারণ। নির্দিষ্ট বয়স, ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য এবং একজন বা দুজন ভ্যারিফায়ারের ব্যবস্থা রেখে আইডি খোলার নিয়ম চালুও হতে পারে ভালো উদ্যোগ। ফেসবুক আইডি খোলার সময় বাংলায় আইনগুলো প্রথম পেজেই দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থার ব্যপারে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভালো ব্যবহার দিয়ে সুন্দর হয়ে উঠবে দেশ, এটাই প্রত্যাশা। এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন তাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি পরিবারকেও। সন্তানদের হাতে অ্যান্ড্রয়েড তুলে দেওয়ার আগে সবকিছু সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিন। সন্তানকে বোঝান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে নিজেকে সবার কাছে ভালোভাবে প্রকাশের মাধ্যম। সন্তানকে আইন সম্পর্কে ধারণা দিন এবং তাদেরকে তথ্যপ্রযুক্তির ভালো ব্যবহারগুলো চিহ্নিত করে দিন।
তবে এখন সময় এসেছে গ্রুপ চ্যাটের বিষয়টি নিয়ে ভাববার। গ্রুপ চ্যাটের ফলে অপরাধ বাড়ছে। এ কারণে গ্রুপ চ্যাট বন্ধে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। মনে রাখতে হবে একটি সঠিক ব্যবস্থাপনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে দেশের সুন্দর পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম।
লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি
শ্রীপুর, গাজীপুর