• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
খবরগুলো সব একই দিনের

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

খবরগুলো সব একই দিনের

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৪ মার্চ ২০২০

কথা প্রসঙ্গে আমার এক সুহূদ সেদিন বলছিলেন, এখন আর পত্রিকা পড়তে ইচ্ছে করে না, টিভিতে খবরও দেখি না, একসময় যে টক শো দেখার জন্য টিভি রিমোটের দখল নিয়ে গিন্নির সঙ্গে মল্লযুদ্ধ বেঁধে যেত, এখন সে টক শো দেখার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছি। খবর পড়া ও দেখার প্রতি তার কেন এই অরুচি—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট ইত্যাদি সব মন খারাপকরা খবর। টিভিতে দেখি সেসব খবরের সচিত্র বর্ণনা। আর টক শোতে নানা রাজনৈতিক বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা কথা বললেও দেশের মৌলিক সমস্যা সমাধানে কেউ আসল কথাটি বলেন না। কোথাও আশাব্যঞ্জক খবর নেই। সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য সর্বদাই আশাজাগানিয়া বাণী শুনিয়ে থাকেন। তবে তাদের সে বাণী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসার বাণীতে পরিণত হচ্ছে। তাই এখন আর ওসবে আগ্রহ নেই। ভদ্রলোকের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ৫ মার্চের পত্রিকাগুলোর দিকে চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ করলাম। সত্যিই, গতানুগতিক খবরের পাশাপাশি আঁতকে ওঠার মতো খবরে পাত্রিকাগুলো সয়লাব। এখানে কয়েকটি খবরের নমুনা তুলে ধরছি। ‘বাংলাদেশের খবর’ ও ‘সময়ের আলো’ বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে রাজউকের একটি তুঘলকি কাণ্ডের খবর। বলা হয়েছে, মাদানী অ্যাভিনিউ খ্যাত ১০০ ফুট রোডের পাঁচখোলা খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণের নামে ফসলি জমিকে খাল বানিয়ে তার ওপর ব্রিজ নির্মাণ করছে রাজউক। স্থানীয় অধিবাসী ও জমির মালিকরা বাধা দিয়ে কোনো কিনারা করতে পারেনি। ‘আমাদের সময়’-এর বিশেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘লোকসানে ডানা ভাঙা দেশি উড়োজাহাজ’। এই প্রতিবেদনে আমাদের জাতীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরের নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির কথাই তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিমানের লোকসানও। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর প্রধান শিরোনাম ‘পাচারে হয়ে যত বিপর্যয়’। এতে বলা হয়েছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। হুন্ডি, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। পত্রিকাটি লিখেছে, এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সমাজের উঁচুস্তরের লোক। ‘সমকাল’-এর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘এক টাকাও ছাড় হয়নি, খরচ ২২ কোটি টাকা’। সম্ভাবনাময় উদ্যোগকে সহায়তা দিতে সরকার কর্তৃক গঠিত তহবিল ইএসএফে- হরিলুটের খবর ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তহবিল পরিচালনায় গঠিত উইং বা অফিস থেকে সম্মানী ও আপ্যায়ন ভাতার নামে ওই পরিমাণ অর্থ উদরস্থ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রতি কার্যদিবসে আপ্যায়ন খরচই দেখানো হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। অথচ উল্লেখিত তহবিল থেকে সহায়তা প্রকল্পে কোনো অর্থই এখনো পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়নি। ‘সমকাল’-এর আরেক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে অবৈধ কারখানায় উৎপাদন ও চোরাইপথে সিগারেট আমদানির ফলে প্রতিবছর সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারানোর তথ্য। পত্রিকাটি লিখেছে, এ ধরনের ফাঁকির কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। একই পত্রিকার আরেকটি খবরের শিরোনাম ‘রাজধানীতে দুই ওসির বিরুদ্ধে মামলা’। খবরে বলা হয়েছে, নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে ৪ মার্চ দক্ষিণখান থানার ওসি শিকদার শামীম হোসেনসহ ১০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন এক ভুক্তভোগী নারী। অন্যদিকে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছেন অপর এক নারী। একই দিনে প্রায় সবগুলো পত্রিকায় বেরিয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি প্রতিবেদন। তাতে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৪ জন।  এদের মধ্যে শিশু রয়েছে ৭৪ জন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রণীত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৪ জন। ওই দিনই পত্রিকাগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে বিআইডব্লিউটিএর নদী দখলবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে সরকার দলীয় একজন এমপির বাধাদানের খবর। বুড়িগঙ্গা তৃতীয় সেতুর (বছিলা) পশ্চিম পাড়ে নদীর জায়গা দখল করে সরকারদলীয় এমপি আসলামুল হকের গড়ে তোলা পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে এমপি মহোদয় দলবল নিয়ে ছুটে আসেন তা প্রতিহত করতে। তবে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের অনমনীয়তার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন।

সাবেক এমপি ও পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএমএ আবদুল আউয়াল ও তদীয় পত্নী লায়লা পারভীনের জামিন নিয়ে পিরোপুরের জেলা জজ আদালতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ফলোআপ খবর ছিল ৫ মার্চের পত্রিকাগুলোতে। খবরে দেখা যায়, আবদুল আউয়াল তার জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পেছনে ওই আসনের বর্তমান এমপি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। বলেছেন, তাকে যাতে জামিন দেওয়া না হয়, সে জন্য জজ আবদুল মান্নানকে প্ররোচিত করেছিলেন মন্ত্রী। অপরদিকে আবদুল আউয়ালের অভিযোগকে সর্বৈব মিথ্যা বলে দাবি করেছেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

এক দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত উপরোল্লিখিত খবরগুলো যে মোটেই স্বস্তিকর নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং এসব খবর জনমনে হতাশাকেই আরো বৃদ্ধি করবে। রাজউকের জমি কেটে খাল বানানো, বিমানের লোকসান, অর্থ পাচার কিংবা ওসিদের অপকর্ম কোনোটাই ভালো খবর নয়। এসব খবর রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের অভ্যন্তরে দুর্নীতি-অনিয়মের শক্ত-পোক্ত আসন গেড়ে বসার প্রমাণ বহন করে। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামজিক শৃঙ্খলা যে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভেঙে যেতে বসেছে, তা অস্বীকার করার কি জো আছে?  লক্ষণীয় হলো, এ ধরনের পিলে চমকানো খবর একটার পর একটা আসছেই। একটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি সামনে এসে হাজির হচ্ছে। আওয়ামী মহিলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার কাহিনী এখনো তরতাজা। তার রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই আলোচনার কেন্দ্র দখল করেছে পিরোজপুরের জেলা জজ আদালতের ঘটনা। এ নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা চলছে। কেউ কেউ এ ঘটনাকে বিচার বিভাগের ওপর সরকার বা সরকারি দলের নগ্ন হস্তক্ষেপের নিদর্শন বলছেন। আইনমন্ত্রী অবশ্য এই বলে ঘটনার ছাইচাপা দিতে চেয়েছেন যে, ওই জজ সাহেব আইনজীবীদের সঙ্গে অশালীন ও রূঢ় আচরণ করেছিলেন। এতে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। উত্তেজনা প্রশমনের জন্যই বিচারককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে মন্ত্রী মহোদয় যা-ই বলুন, ওই ঘটনা জনগণের কাছে যে বার্তাটি সরবরাহ করেছে, তা সরকারের জন্য কোনোমতেই স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। ঘটনাটিকে আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার জন্য অশনিসঙ্কেত বলে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ—টিআইবি। অপরদিকে পিরোজপুরের জেলা জজকে বদলির আদেশকে কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ৪ মার্চের বিভিন্ন পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবরের প্রতি দুজন আইনজীবী কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ রুল জারি করেন।

ঘটনাটি সচেতন ব্যক্তিদের ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা, এ ঘটনায় নিম্ন আদালতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ও হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, জজ সাবেক এমপি ও তার স্ত্রীর জামিন নামঞ্জুর করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে লিপ্ত হন। তারা জজের অপসারণ দাবি করেন। আওয়ামী লীগ-সমর্থক আইনজীবীরা আদালত বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরই মধ্যে জজ আবদুল মান্নানের প্রত্যাহারের নির্দেশ যায় ঢাকা থেকে। আর একই আদালতের অন্য এক বিচারক আবদুল আউয়াল দম্পতির জামিন মঞ্জুর করেন। ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে, তাতে আদালতের কাজে সরকার দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠা স্বাভাবিক নয় কি? সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, সাবেক এমপি আবদুল আউয়ালের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ। তার জামিন নামঞ্জুরের জন্য মন্ত্রী রেজাউল করিম জজকে প্ররোচিত করেছিলেন—এ অভিযোগের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে আদালতের ওপর ক্ষমতাসীনদের প্রভাব খাটানো-সংক্রান্ত বিরোধী দলগুলোর অভিযোগকে কিছুটা হলেও যে যৌক্তিক ভিত্তি দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা দেশবাসীকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়েছে। ‘টেন্ডার মোগল’ খ্যাত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের গোপনে দুটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পাবার ঘটনাকে অনেকের কাছেই অলৌকিক বলে মনে হয়েছে। কী জাদুমন্ত্রের বলে সে অতি সন্তর্পণে জামিন বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল, তা নিয়ে চলছে নানান কথাবার্তা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তার এ জামিন প্রাপ্তির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ নাকি কিছুই জানে না। হা হতোষ্মি! এ যেন ভোজবাজির খেলা! অবশ্য ৮ মার্চ উচ্চ আদালত সে জামিন আদেশ বাতিল করে দিয়েছেন। 

দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। কেমন যেন একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ চারদিকে। যেটা যেভাবে চলা উচিত, সেটা সেভাবে চলছে না। দায়িত্বশীলরা তাদের কাজকর্ম-কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছেন না। নিয়ন্ত্রণ শব্দটি ক্রমেই যেন অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। সরকার কঠোর হাতে বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজ ঘরে কেমন যেন অগোছালো। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র বা যুবসংগঠনের কর্মীদের কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। পাশাপাশি প্রশাসনের একটি বিরাট অংশ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা কাউকে তোয়াক্কাই করতে চায় না। ভাবটা এমন—‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে...’। বলা নিষ্প্রয়োজন, এই পরিস্থিতি কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের স্বাভাবিক চিত্র নয়।

মাত্র এক দিনের (৫ মার্চ) সংবাদপত্র থেকে যে খবরগুলো শুরুতে তুলে ধরেছি, তা থেকে এটা অনুমান করা কষ্টকর নয় দেশের পরিস্থিতি কেমন। সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। কথাটি সর্বাংশে সত্য। কেননা, প্রকাশিত খবরগুলো কেবল খবর নয়, সমাজের বিদ্যমান অবস্থারই প্রতিচ্ছবি। নানা অপকাণ্ডে আমাদের এই সমাজ যে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠছে দিন দিন, তা কী অস্বীকার করা যাবে? ক্রমশ আমরা যেন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে। সে সর্বনাশা পথ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads