• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
শোকের মেঘে অন্ধকার পৃথিবী

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

শোকের মেঘে অন্ধকার পৃথিবী

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ০৩ এপ্রিল ২০২০

সকালের সূর্যটাতে আলো নেই। রাতের অন্ধকারটা অনুভব করতে পারি না। স্নিগ্ধতা পাই না চাঁদের পরশেও। প্রতিদিনের মৃত্যুমিছিল অনুভূতিকে যেন নির্বোধ করে রেখেছে। শোক জমতে জমতে বুকটা পাথর হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার স্বজনের গগনবিদারী আর্তনাদ উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত শোকে কালো করে ফেলেছে পৃথিবীর আকাশটাকে। মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে চলছে শোকের আয়তন। আগ্নেয়গিরির মতো হঠাৎ বিস্ফোরণ নয়, সুনামির মতো ধেয়ে আসা জলরাশির পাহাড়ও নয়, প্রাণঘাতী করোনা যেন বলে-কয়ে সংহার করছে তাজা তাজা প্রাণ! সভ্য পৃথিবীর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ধর্ম সবকিছুকেই টুঁটি চেপে ধরেছে প্রাণঘাতী এই করোনা। এ নিয়ে কিছুই করার নেই মানুষের। বিশ্বজুড়েই চলছে এই তান্ডব। মানবিক পৃথিবীর কূল ভেঙে ভেঙে লাশের স্রোত কেবল বাড়ছেই। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই চরম বিপর্যয়। কম সময়ে এত স্বজনকে হারানোর রেকর্ডও এটি। প্রতিদিন মৃত্যু বাড়ছে চক্রাকারে। শোক বইতে পারছে না পৃথিবীর মাটি-আলো-বাতাস।

অহংকার আর প্রাচুর্যের ঐশ্বর্যমন্ডিত আইফেল টাওয়ার, বুর্জখলিফা শোকে মুহ্যমান হয়ে হেলে পড়েছে। ইতালির পাম্পেই নগরীর ধ্বংসলীলা ভুলে এখন কাঁদছে একসময়ের নিষ্ঠুর ভিসুভিয়াস। শোকের উত্তাপে গলছে আল্পস পর্বতমালা। শোকজলে উপচে পড়ছে টাইবার নদী। দুপাশে নান্দনিক প্রাচুর্য আর ক্ষমতার দম্ভে ভরা ব্রিটেনের টেমস নদীও ফুঁপিয়ে উঠছে শোক সইতে না পেরে। 

বোহাই সাগরের মোহনায় প্রযুক্তির ঈশ্বরখ্যাত চীন যেন মহাপ্রলয়ের সাক্ষাৎ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। চিরদুঃখী হোয়াংহোর দুঃখের কান্নাজল ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর প্রান্তজুড়ে। উহানের আকাশের ভস্মীভূত ধোঁয়ায় লেপ্টে গেছে সভ্যতার এপিঠ-ওপিঠ। স্পেনের এরো, গুয়াদালকিবির, গুয়াদালিমা আর গুয়াদিয়াতো নদীতে শোকের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এবারের মৃত্যমিছিল তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে ভূমধ্যসাগরের অনেক করুণ ইতিহাসের কথা।

শিল্প, সংস্কৃতি আর নৃতাত্ত্বিক অহংকারের শেখ সাদির ইরানকেও ছুঁয়ে গেছে করোনার নীল বিষ। বিশ্বমোড়ল আমেরিকা, রাশিয়া কেউই বাদ যাচ্ছে না করোনার ভয়াল থাবা থেকে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অসীম সৌন্দর্য মলিন হয়ে গেছে আমেরিকানদের শোকে-শোকে। ধনী-গরিব, অক্ষম-সক্ষম কেউ বাদ পড়ছে না দুনিয়া পাল্টে দেওয়া এই করোনার বিষ থেকে। করোনা যমদূত প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ। একক দশক শতক হাজার যেভাবে অতিক্রম করছে, তাতে অযুত লক্ষ ছুঁতে হয়তো আর কদিন বাকি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, প্রতিরোধ করতে না পারলে বিশ্বের অন্তত সাড়ে ছয় কোটি মানুষের প্রাণ যাবে এই ভাইরাসে। প্রতিষেধক নেই, তাই সংক্রমণ রোধের একমাত্র উপায় সচেতনতা। এর বিকল্প আর কিছু নেই। 

২ এপ্রিল পর্যন্ত পৃথিবীর ২০২টি দেশে সংক্রমিত হয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। হয়তো আরো ছড়াবে। জানি না প্রকৃতি কোন চেহারায় তৈরি করবে আগামীর পৃথিবী। এর আগে ১৯৭৬ সালে আরেক প্রাণঘাতী ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর মানুষ। ২০১৪-১৫ সালে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমের দেশগুলোতে ১১ হাজার ৩৩৩ জন মানুষ মারা যায়। একই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ১ হাজার ১৫৩ জন মানুষ প্রাণ হারায়। অন্যদিকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুটিবসন্ত দুনিয়াজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করে। প্রাণ কেড়ে নেয় ৩০ কোটি মানুষের। ১৯১৮-১৯১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রাণ যায় ১০ কোটি মানুষের। আরেক ভয়ংকর ভাইরাস হচ্ছে রেবিজ। এটাতে প্রতি বছর প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ ছাড়া মারবুর্গ, ডেঙ্গু, এইচ৫এন১-এর মতো ভাইরাস পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে আক্রান্ত করে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তবে এই শতকে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে এসেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। খুব কাছাকাছি সময়ে দুনিয়াজুড়ে এর আক্রমণ। গত ২ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত মারা গেছে ৪৯ হাজার ১শত ৮৫ জন মানুষ। 

এর আক্রমণ থেকে আমরাও নিরাপদে থাকতে পারিনি। দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫৬ জন, মারা গেছে ৬ জন। করোনা থেকে বাঁচতে সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকমের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের দৃশ্য ভিন্ন। দেশের মানুষের চরম অসচেতনতা আর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বারবার হতাশায় ভাবিয়ে তোলে অনেকের মতো আমাকেও। কারণ আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের খুব কাছাকাছি এসে গেছি। সামনে কোন বিভীষিকা অপেক্ষা করছে জানি না। প্রতিদিন করোনার বৈশ্বিক দুঃসংবাদ দেখি আর আশঙ্কার প্রহর গুনি কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাসে- আমাদের যে কী হবে! শেষতক মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই আমাদের দেশে তেমন ক্ষতি হবে না। এটা ভেবেই আশাবাদী হই। এ ছাড়া বিকল্প ভাবার পথ খোলা নেই সামনে। কারণ প্রকৃতি তার নিয়মেই চলবে, এখানে কারো কিছু করার নেই। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বসন্তের প্রথমদিকে বৃক্ষরাজিতে বাতাসের ঝাপটায় বিবর্ণ পুরোনো পাতাগুলো ঝরে যায়। পত্রপল্লবে কাঁচা সবুজের রং নিয়ে আবারো নবরূপে ফিরে আসে সবুজ প্রকৃতি। পৃথিবীর সব দেশেই পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলার এমন ঋতুবৈচিত্র্য আছে। তেমনি এই করোনাকালকেও আমার মনে হয় মানবজাতির জন্য বৈশ্বিক পরিবর্তনের এক অবধারিত নিয়ম, যা শতাব্দী পরপর বা অনুকূল সময়ে পরিবর্তন এনে দেয় সভ্যতার ইতিহাসে। যেটাকে আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সঙ্গে তুলনা করি। আমরা যখন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করি, তখন প্রকৃতির কষ্ট বা ব্যথা বুঝি না। প্রকৃতি যখন নিজ ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করে নেয়Ñ তখন আমরা হয়ে যাই ঘটনার শিকার। যোজন যোজন দূরত্বের সম্পর্ক নিমিষেই কাছের হয়ে যায়। শোকে শোকাতুর হই একে অপরের জন্য। এর ভয়াবহতা যখন দুনিয়াজুড়ে হয়, তখন পুরো পৃথিবীর শোকাবহ পরিবেশ একাকার হয়ে গগনবিদারী হয়ে ওঠে আমাদের আর্তনাদ। শোকের মেঘে অন্ধকার হয়ে যায় পৃথিবী। বদলে যায় চিরচেনা দৃশ্যপট, বদলে যায় মানুষ ও তার চিন্তা। টিকে থাকাদের জীবনচাকা ঘুরতে শুরু করে আবার যথানিয়মেই ।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads