• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

সময়ের নির্মমতা এবং আমাদের চ্যালেঞ্জ

  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২০

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

 

 

 

ক্রাইসিস এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়টাতে আমাদের  সকলের সম্যক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবন পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত এটি মোকাবিলা করেই সভ্যতা বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। একজন নিরেট সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অতি জ্ঞানীদেরও প্রতিনিয়ত এ অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। কিছু ঘটনা আছে যা বারংবার আসে বলে পূর্বাভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে গৎবাঁধা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই ন্যূনতম ক্ষতিসাধন সাপেক্ষে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি ছাড়াই ঐসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা যায় কিংবা বিপদ থেকে নিজেকে উৎরানো সম্ভব হয়। কিন্তু যে বিষয়টা মানুষ কখনো দেখেনি বা অনুমান করেনি হঠাৎ সৃষ্ট কোনো সমস্যা তা মানুষ কর্তৃক হতে পারে আবার সোর্স প্রাথমিকভাবে একেবারে অজ্ঞাতও থাকতে পারে আর মুশকিলটা মূলত সেখানে।

আজকের বিশ্বের নীরবতা, স্তব্ধতা, ভয় জরাগ্রস্ততা যা-ই কিছুই বলি না কেন, এমন প্রেক্ষাপট সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা নেই তা দৃশ্যমান। বিশ্বমানবের শ্রেণি বিভাজন, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কম শিক্ষিত, উন্নত-অনুন্নত, ধার্মিক-অধার্মিক যেমন করেই বলি না কেন বর্তমান  করোনা আক্রান্ত বিশ্বে এগুলোর কোনো মূল্য নেই। কারণ সকলের কাছেই এটি অপরিচিত এবং নতুন। ফলে বিশেষায়িত কোনো গোষ্ঠী বা জনপদের জন্য এটি নিরাপদ আর অবশিষ্টাংশের জন্য এটি অনিরাপদ তেমনটি নয়। করোনা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য একই রকম বিষয়। যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত তারা এর শারীরিক প্রভাবটা উপলব্ধি করেছেন আর যারা এখনো মুক্ত রয়েছেন তারা সবাই এক অজানা আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যম যা পাচ্ছে তা প্রচার করার চেষ্টা করছেন আর মানুষের কোনো প্রাথমিক পূর্ব পরিচিতি না থাকায় যা সামনে আসছে তাই জানার চেষ্টা করতে হচ্ছে।

বলা বাহুল্য বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত এত মানুষ লেখালেখিতে বিশেষ করে ফেসবুকে লিখছেন সত্যিই এটি জঙ্গল ব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক, কার সোর্স কি, কারো শোনা কথা, কারো ধর্মীয় বক্তব্য সবকিছু মিলে এত তথ্য আর তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে যে কার্যত এটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্য থেকে বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্যটি আহরণ করা খুবই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করাটা সকলের জন্যই মঙ্গলজনক মনে করি। অধুনা বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়ায় বাঁচা গেছে এক শ্রেণির ঝাড়ফুঁক দেওয়া মানুষ আছে তারা সবকিছুতেই ঝাড়ফুঁক দিয়ে সারিয়ে তোলেন এ প্রবণতাটা এখনো বিশ্বাস করি প্রতারণার মাঠে নামে নাই। মাঠে আর না নামুক সেটাই ভালো। শেষে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ানোর দৃশ্য দেখতে হতো।

প্রসঙ্গক্রমে যে কারণে আজকের কলম হাতে নেওয়া তা অবশ্য করোনা থেকে শুধু মুক্তির লক্ষ্যে নয় বরং ভবিষ্যতে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে কী পরিমাণ ক্ষতি বহন করতে হবে, সে লক্ষ্যে দৃষ্টি প্রসারিত করার চেষ্টা মাত্র। আমরা বস্তুত এখন অব্দি কেউই জানি না করোনার ক্ষতি করার সামগ্রিক ক্ষমতা কতটুকু। তবে ছিটেফোঁটা যা কিছু আঁচ করতে পারছি তা নিশ্চয় অমূলকও নয়। চলমান বিশ্বব্যবস্থায় যা কিছু আছে বর্তমানে অচল কিংবা সাময়িক স্থগিত রয়েছে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তে বোঝা যাবে কোন খাতে কতটুকু পরিবর্তন আসতে পারে।

শিক্ষা, বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, কলাসাহিত্য, এমনকি মানব মস্তিষ্কের চিন্তাজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনতে হবে। অন্যথায় প্রকৃতি ও চলমান বিশ্ব মানুষের জন্য অনিরাপদ ও অনাস্থার ক্ষেত্র তৈরি করবে যার পরিণাম আরো ভয়াবহ হতে পারে। খেয়াল করুন প্রচলিত সকল বক্তব্যের বাইরে মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই হচ্ছে যথাযথ। এরকম নানান নতুনত্বের সাথে মানুষকে ভবিষ্যৎ অভিযোজন করতে হবে।

ভাবুন তো আমাদের কোনো খামখেয়ালি বক্তব্যে আমাদের দেশের মানুষকে যদি ভয় আর আতঙ্ক দ্বারা চালিত হয়ে লম্বা একটা সময় দিনাতিপাত করতে হয়, এর ফলে নারী, শিশু কিংবা বয়স্ক মানুষের যদি এটা মস্তিষ্কে স্থায়ী আসন পেতে বসে, সেক্ষেত্রে ভালো থাকা সুস্থ মানুষকে কি পরিমাণ অসুস্থ কিংবা মানসিক জরাগ্রস্ততা মানুষকে বহন করতে হবে তা কিন্তু এই মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে অনুমান করা দুষ্কর। বাস্তবে এমনটা অমূলক হোক সেটাই কাম্য। তবুও বলতে হয়, যেমনটা আমরা ইতালি, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে দেখলাম বিভীষিকায় পড়ে বৃদ্ধ বা ষাটোর্ধ্ব মানুষকে করোনা চিকিৎসা না দিতে। তারা ধরেই নিয়েছে বয়সের কারণে ঐসব লোকের আর কিছু নতুন করে দেবার  নেই এ বিশ্বকে। তাই তাদেরকে আর প্রয়োজন  নেই।

আমি এতক্ষণ যা কিছুই বলার চেষ্টা করেছি কিংবা বোঝানোর চেষ্টা করেছি তা হলো এই অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যেও শিশুদের যতদূর সম্ভব পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে, যেন বিশ্ব-শিশুরা অপুষ্টির শিকার না হয়। দূরদর্শন বা ডিজিটাল ক্ষেত্রে শিশুদের মনোস্তত্ত্ব ও মেধা বিকাশে সাহায্য করবে এমন শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা। পারিবারিক কেয়ারে থাকা শিশুদের জন্য ভাইবোন ও বাবা-মাকে এই সময়ে তাদের মনোস্তত্ত্ব বুঝে আচরণ ও সাপোর্ট করাটা খুব বেশি কাজে দেবে। তেমনটা সাধারণ নারী-পুরুষ ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও বিশেষ আচরণের ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে ।

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পরিমিত ব্যায়াম, লেখাপড়া করে সময় কাটানো, খানিকটা গান-কবিতা, নাটক-সিনেমা ইত্যাদি দেখে বিনোদন উপভোগ করতে হবে। অন্যথায় দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হলে প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণও ত্রুটিপূর্ণ হবার সম্ভাবনা থেকে যাবে। কাজেই আজকে বসেই আগামী কালের ভাবনাটাও ভাবতে হবে, যেন সময় থাকতেই সাধন হয়।

পরিশেষে বলব মস্তিষ্ক সুস্থ ও কার্যকর রাখার লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা যেসব সাংস্কৃতিক অভ্যাস তাকে আনন্দ দেয়, বিনোদন উপভোগ করায়, মেধা-মনন সক্রিয় রাখে, সেগুলো মানুষকে খাদ্যাভ্যাসের মতো নিয়মিত চালিয়ে যেতে হবে নিজেদের সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়।

 

লেখক : গীতিকবি ও প্রাবন্ধিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads