• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসমান গণির প্রেত

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসমান গণির প্রেত

  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০২১

আমরা কী ভুলে গেলাম আবদুর রাজ্জাককে? সেই আবদুর রাজ্জাক; যিনি পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে এই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়ে ওঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। সেগুলোর অন্যতম হলো— বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও শিক্ষকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা পালন। এ কারণে কর্তৃত্বকামীদের হাতে কম নাস্তানাবুদ হতে হয়নি তাকে। এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়েছে। অগুনতি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। মামলা দিয়ে রাখা হয়েছে দৌড়ের ওপর। এমনকি ষাটের দশকের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আইয়ুব খানের শাসনামলে অশিক্ষিত গভর্নর মোনেম খাঁর পদলেহনকারী উপাচার্য ড. ওসমান গণি এই কার্যসাধনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার নির্লজ্জ প্রশ্রয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নরকে পরিণত করেছিল এনএসএফের গুন্ডারা। সে সময় বহু মেধাবী শিক্ষক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে রেহমান সোবহান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ড. আবু মাহমুদ অন্যতম। এসবের নেপথ্যে ছিলেন ড. ওসমান গণি। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার কারণে মুনীর চৌধুরী ও মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন তিনি। আইয়ুব খানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উপাচার্য ওসমান গণিও বিদায় হয়েছিলেন। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চাশ বছর বাদে এই ওসমান গণিরই প্রেতের সন্ধান মিলেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’দফার উপাচার্য ড. ফায়েক উজ্জামানের নড়বড়ে দেহে। কোট-পাতলুন আর সামন্ত মানসিকতায়। বেশ কিছুকাল ধরেই জানা যাচ্ছে— তার দুষ্কৃতির বীজ বেশ লম্বা হয়েছে। অথর্ব-আত্মীয় নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাইগাদায় পরিণত করা, একাডেমিক ভবনের পাঁচ ইঞ্চির ছাদ তিন ইঞ্চি করে উন্নয়নের টাকা তছরুপ করা, প্রতারক জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, নারী চাকরিপ্রার্থীকে যৌনহেনস্তা করা। কী করেননি তিনি? মেয়াদ শেষের দিনদশেক আগে নৈতিক ছাত্র-আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে দুজন ছাত্র ও অন্যায়ের বিপরীতে দণ্ডায়মান তিনজন মেরুদণ্ডী শিক্ষককে বহিষ্কার করে নিজের শেষরাতের মার জানান দিলেন এই হিটলার-ওস্তাদ। কামেল কৌশলে দেখালেন নিজের আখেরি-মাজেজা। আর স্বাধীন দেশে স্থাপন করলেন কর্তৃত্বকামিতার প্রভুসুলভ এক অসভ্য ও ঔপনিবেশিক নজির।

প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে পত্রিকাগুলোতে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে যে তরজা শুরু হয়েছে— সেখান থেকে যেকোনো মস্তিষ্কহীন মানুষের কাছেও একটি বিষয় স্বভাবতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে— ছাত্র ও শিক্ষকদের বহিষ্কার করা হয়েছে ব্যক্তিগত রোষের কারণে। বহিষ্কৃত দুজন ছাত্র; ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিনের তৃতীয় বর্ষের মোবারক হোসেন নোমান এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের ইমামুল ইসলামের বিরুদ্ধে উপাচার্য-পরিষদের প্রধান ক্ষোভ হলো— তারা গত বছরের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যে অহিংস আন্দোলনের দাবি ছিল ছাত্রদের বেতন কমানো ও আবাসন সংকটের নিরসনসহ পাঁচটি। প্রশ্ন রাখতে চাই— এগুলো কি কোনো অন্যায় দাবি? এ তো অধিকারের প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় যেটি পূরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, প্রতিশ্রুত। পাগলে একথা বুঝলেও প্রতাপী শাসক উপাচার্যকে সেটি বোঝাবে কে? তবে পাকা মাথা বলেই তিনি বোঝেন— আন্দোলনকে আশ্রয় করে তো মার দেওয়া চলে না। তাতে অভিযোগটি ঠিক পাকা হয় না। সুতরাং ঘুঁটি সাজাতে হবে ভিন্ন কায়দায়। এই খেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোসাহেবরা, দুষ্কৃতির সাগরেদরা এগিয়ে এলেন। একেবারে সাড়ম্বরে। নোমান ও ইমামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হলো— তারা আন্দোলন চলাকালে দুজন শিক্ষককের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন। যে অভিযোগের তারল্য ইতোমধ্যেই টলমলিয়ে উঠেছে। কাছা গেছে খুলে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা হাদী চত্বরে অবস্থান করছিলেন। ঠিক ওই সময় দুজন শিক্ষক গাড়ি চালিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা অনুরোধ করে গাড়ি ঘুরিয়ে দেন। সেদিনের একটি ভিডিও ফুটেজেও তাদের এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। একেবারে নির্জলা সত্য। ছাত্রদের বক্তব্য— অভিযোগের ব্যাপারে নোটিশ পাওয়ার পর বক্তব্য দেওয়ার জন্য তারা ছাত্র বিষয়ক পরিচালকের দপ্তরেও গিয়েছিলেন। তবে দপ্তর থেকে তাদের উল্টো অসহযোগিতা করা হয়েছে। ঘোরাঘুরির পরও অভিযোগের অনুলিপি দেওয়া হয়নি। এরপর ১৩ জানুয়ারি নোমানকে এক বছরের জন্য ও ইমামুলকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এই দুই শিক্ষার্থী অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারের জন্য ১৭ জানুয়ারি রোববার থেকে আমরণ অনশন নেমেছেন। হিংস্রতা নয়, অনুসরণ করেছেন অহিংসতাকে, গান্ধীবাদকে। এই হাড়-মাংস জমিয়ে দেওয়া মাঘী-ঠান্ডায়, অভুক্ত-নির্জলা-ক্লিন্ন দেহে শুয়ে রয়েছেন প্রশাসনিক ভবনের সামনে। আটচল্লিশ ঘণ্টারও অতিরিক্ত কেটে গেছে। ইতোমধ্যে নোমান বেশ কাবু হয়ে পড়েছেন।

এই লজ্জায় মুক্তবুদ্ধির মানুষদের মাথা যখন নুয়ে আসছে, তখন বিকারে পাওয়া উপাচার্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপালেন। বরখাস্তের চূড়ান্ত নোটিশ পাঠালেন— বাংলা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক আবুল ফজল, প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা রাখঢাক না রেখেই তোলা হয়েছে— আন্দোলনে তারা ছাত্রদের পক্ষ নিয়েছিলেন। করেছেন গুরুতর অপরাধ! শোনা যাচ্ছে— তল্পিবাহক একাডেমিক কাউন্সিলের মস্তিষ্কহীন সদস্যরা এই অসভ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ‘রা’ পর্যন্ত কাড়েননি। অসভ্য বলছি এ কারণে যে, পৃথিবীর কোথাও কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে ছাত্রদের নৈতিক আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে তিনজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে? এ নজির আমরা ঔপনিবেশিক আমলেও দেখেনি। এমনকি চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়ার পর কারণ দর্শানোর জন্য শিক্ষকদের মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার সময় দেওয়া হয়েছে। এটি তামাশা ছাড়া আর কী হতে পারে! বোঝাই যায়, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার গণমাধ্যমের সামনে গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের যে কাঁদুনি গেয়েছেন, সেটি আসলে থিয়েটারি ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষকদের বরখাস্তের ফরমান আগেই পাকা করা হয়েছে। উপাচার্য ও মোসাহেবদের মূল উদ্দেশ্য তাদের অপকর্মের পথ সাফ করা। মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির বিকাশ রোধ করা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার প্রধান মুখ আবুল ফজল। তাকে যারা সামান্যও চেনেন; একবাক্যেই বলবেন বিদ্যায়-বত্তায়-পাণ্ডিত্যে, পেশাগত প্রতিশ্রুতিতে; সমকালে তার তুল্য শিক্ষক এদেশে নেই বললেই চলে। আজন্ম মেরুদণ্ডী এই মানুষটি প্রকৃতই আপসহীন। এহেন চরিত্রবান শিক্ষককে না সরালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কোনোভাবেই কর্তৃত্ব ফলাতে পারছিলেন না উপাচার্য ও মোসাহেবরা। ভাগ করতে পারছিলেন না হালুয়া-রুটি। আর শাকিলা আলম ও হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীর ওপর কোপ পড়ার কারণ হলো, তারা আবুল ফজলের নৈতিক সমর্থক, ভাবশিষ্য। সুতরাং তাদেরও রেয়াত করা চলে না। উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান যে প্রকৃতই প্রেতাবিষ্ট। এর পরিচয় মেলে তার চরিত্রের ভয়ংকর প্রতিশোধ-পরায়ণতা দেখেও। তিন দিন আগে তিনি অনশনরত ছাত্রদের বলেছিলেন অনশন ভেঙে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। নিরপরাধ ছাত্ররা এই প্রস্তাবে রাজি হননি। রীতিমতো তাজ্জব হতে হয়— না রাজি হওয়ায় উপাচার্য তল্পিবাহক পরিষদ নিয়ে সভা করে সেদিনই ওদের সাজা আরো একবছর বাড়িয়েছেন। জোর বিবমিষা আসে। এহেন বিকারে পাওয়া মানুষ কী করে থাকেন উপাচার্য পদে? ছাত্ররা কী তার হাতের পুতুল? আর মুক্তবুদ্ধির শিক্ষকরাও? মানুষের জীবন নিয়ে এ কী খেলায় মেতেছেন তিনি? আজ দেশের প্রতিটি বিবেকবান ছাত্র-শিক্ষক-মানুষকে এই অন্যায়ের প্রতিবাদে শামিল হতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিবাদটাই এখন ‘ধর্মকাজ’। অন্যায়টাকে কোনোভাবেই স্থায়ী বলে মানা যাবে না। প্রেতাবিষ্ট, পাতক, একনায়ক, বিকারগ্রস্ত এই উপাচার্য নিপাত যাক। ভেঙে চুর হয়ে হয়ে যাক বহিষ্কারের কালো শৃঙ্খল।

লেখক : নক্ষত্রনাথ হালদার

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads