• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মুক্তমত

ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ এবং বন্ধের উপায়

  • প্রকাশিত ২৭ জানুয়ারি ২০২১

ইমরান ইমন

 

 

বর্তমানে ধর্ষণ দেশের আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। দিন দিন ধর্ষণপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের পর্দা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই সবার আগে বেশ নান্দনিক উপমায় ধর্ষণের খবর আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ধর্ষণের খবরে খবরে ছেয়ে আছে সমস্ত অঙ্গন।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ধর্ষণ আমাদের দেশে একটি সর্বগ্রাসী অপরাধে পরিণত হতে চলেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী- চলতি বছর গড়ে প্রতি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১১ জন নারী। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। ২০১৭ সালে ৮১৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৭৬ জনকে। আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছিলেন ১০ জন নারী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের সংখ্যা দিন দিন তুমুল বেগে বেড়েই চলেছে।

কয়েক মাস আগে ব্যস্ততম মহানগরী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়। কয়েক সপ্তাহ আগে কুমিল্লায় বাসে এক গার্মেন্টকর্মীকে গণধর্ষণ করা হয়। তখন এদেশের অনেকেই যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন- মেয়েটি একা ছিল, মেয়েটির পোশাক, কেন সে একা বের হলো- এসব কুযুক্তিপূর্ণ তকমা লাগিয়ে ধর্ষণের জন্য মেয়েটিকেই দোষী বানিয়েছিল।

তবে আজ মেয়েটি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কাছের মানুষ স্বামীর সঙ্গে বেরিয়েও স্বাধীন দেশের বেশ জনবহুল একটি এলাকায় নিরাপদ থাকতে পারল না। পারল না ধর্ষকদের লোলুপ হাত থেকে বাঁচতে। বিশ বছর বয়সি মেয়েটি স্বামীর সঙ্গে থাকা অবস্থাতেও গণধর্ষণের শিকার হলো। এতক্ষণ যে ঘটনাটি বলছিলাম, সেটি হয়তো এতক্ষণে আপনারা বুঝে গেছেন।

কয়েকমাস আগে সিলেটে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। গত ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিজগৃহে মধ্যযুগীয় কায়দায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সেটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঘটনাটি আলোচনায় আসে। জানা যায়, ঘটনার সাথে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ‘দেলোয়ার বাহিনী’ জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, এই দেলোয়ার বাহিনী-ধর্ষকগোষ্ঠী এত সাহস ও শক্তি কোথা থেকে পায়! এদের পৃষ্ঠপোষক কারা? কোন শক্তিবলে তারা ঘরের ভেতর ঢুকে একজন নারীকে ধর্ষণ ও অমানবিক নির্যাতন করার সাহস পায় এবং সেটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ে!

সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে গ্রুপস্টাডির কথা বলে এক তরুণীকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ অবাক হয়। ধর্ষকের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমাদের দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড— এমন কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও রীতিমতো একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। দেশে অপরাধপ্রবণতা কোন পর্যায়ে চলে গেছে তা গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

দিন দিন ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া। এছাড়া অন্যতম প্রধান কারণটি হলো- রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতার প্রভাব। অপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে অস্ত্র ও শাস্তি ঠেকানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পায়। তারা জানে পুলিশ, আইন, বিচার তথা প্রশাসন  সবকিছুই তাদের অপরাধের আশ্রয়স্থল। তারা জানে এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে। তাই তারা অনায়াসে নির্ভয়ে নানা রকম অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি দেখা গেছে সিলেট, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা জড়িত।

‘কে আমার কী করতে পারবে, দেখি’— ‘আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাব, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন বলয়ের সঙ্গে আমার সংযুক্তি রয়েছে’— যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের এমন মনোভাব সম্পর্কে আমাদের সবারই জানাশোনা রয়েছে। আর এমন আগ্রাসী মনোভাবই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া যায়— এমন বাস্তবতা থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটা শুধু পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা তার শাস্তির ভয় নেই! একটার পর একটা ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটার পর একটা ধর্ষণেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর শোনা যেত, তাহলে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকত।

মানুষের আইন মানার প্রধান কারণ হলো শাস্তির ভয়। আর এর ফলে মানুষ নিজেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে ভয় পায়। কিন্তু মানুষ যখন দেখে সে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তাকে কোনো বিচার বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, তখন সে আর কোনো আইনকে তোয়াক্কা করে না, তার মাঝে কোনো শাস্তির ভয় থাকে না। আর তখনই অপরাধ দুর্বার বেগে বেড়ে চলে। দেশে বর্তমানে ধর্ষণ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ। একটা ধর্ষণেরও যদি দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতো, তাহলে দেশ থেকে ধর্ষণের মিছিল বন্ধ হয়ে যেত।

ধর্ষকের বিশেষ কোনো পরিচয় নেই। ধর্ষক যে-ই হোক বা যেকোনো রাজনৈতিক দল-মতের হোক না কেন, ধর্ষকের পরিচয় সে ধর্ষক। ধর্ষকের শরীর থেকে প্রথমে রাজনীতির পোশাকটি খুলে ফেলতে হবে। তারপর তার অপরাধের জন্য দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে অল্প সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে যাতে পরবর্তী কেউ শিক্ষা নিতে পারে এবং অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে। এর জন্য যদি প্রচলিত আইনের পরিবর্তন করতে হয় সেটাও দ্রুতগতিতে করতে হবে, দরকার হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সংবিধানে কঠোর আইন রয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে। তাই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরো তৎপর হতে হবে। সর্বোপরি ধর্ষণ প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads