প্রতিরোধের সহজ সস্তা নিয়মগুলো না মানার কারণে একটি দাঁতকে চিকিৎসা করে বাঁচাতে কয়েক হাজার টাকা খরচ করি। দাঁতের যত্নে বিশেষ কয়েকটি ভুল সংশোধন করে সময়মতো সঠিকভাবে যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরতে চাই। যেমন-
১. দাঁত ব্রাশ : আপনি যদি অতি জোরে জোরে অনেকক্ষণ ব্রাশটি দাঁতের ওপর ঘষতে থাকেন, তাহলে দাঁতের ওপর শক্ত আবরণ এনামেল ক্ষয় হয়ে যাবে। কয়েকদিনের মধ্যে তখন আপনার দাঁত অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি বা গরম পানিতে শিরশির করবে, খেতে পারবেন না কোনো কিছু। এর ফলে মাড়ি থেকে দাঁত সরে আসবে। সুতরাং বাজারের নরম ধরনের ব্রাশ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপর থেকে নিচে সব দাঁত আস্তে আস্তে পরিষ্কার করতে হবে।
২. প্রতিদিন বেশি পরিমাণে অ্যাসিডিক ফুড খাওয়া : সোডা, কমলার রস, মদ, খেলাধুলার সময় ব্যবহূত পানীয়, ক্যান্ডি ইত্যাদি খাবারে থাকে প্রচুর অ্যাসিড। একটি বরফের টুকরো যেমন পানিতে ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে গলে অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমনি আমাদের দাঁতের সবচেয়ে শক্ত এনামেলও কিন্তু এ ধরনের অ্যাসিডিক ফুডের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যদি এসব খাদ্য খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি বা চিজ জাতীয় খাদ্য খাওয়া না হয়, তাহলে মুখের ভেতর লালার পিএইচ লেভেল কমে গিয়ে দাঁতের ক্ষয় শুরু হবে। যদি কমলা বা আনারস জুস খাওয়ার সময় স্ট্র ব্যবহার করা যায় তবে কিছুটা রক্ষা হয়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় এ-জাতীয় ফলের রস খাওয়ার পর যদি ভালোভাবে কুলকুচি ও সেই সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করা যায়।
৩. দাঁতকে অতিরিক্ত সাদা করার চেষ্টা : আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাঁতের রঙ পরিবর্তন হয়, তখন এগুলো আর সাদা থাকে না। কিন্তু এই দাঁতগুলোকে সাদা করার জন্য যদি অতিরিক্ত ব্লিচিং করা হয়, তাহলে দাঁতের এনামেল বা আবরণ অ্যাসিডের আক্রমণের শিকার হয় এবং এনামেলের আবরণ ফেটে একটু ফাঁকা হয়ে যায়। ফলে দাঁত শিরশির করে।
৪. হট পিজ্জার সঙ্গে ঠান্ডা পানীয় : যখনই আমরা অতিরিক্ত গরম পিজ্জা বা শিঙাড়া বা পেঁয়াজুতে কামড় দিই, তখনই কিন্তু আমরা আমাদের দাঁতের শক্ত আবরণ এনামেলকে বাড়িয়ে ফেলি এবং সেই সঙ্গে যখন আমরা ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিই, তখনই কিন্তু এনামেলে চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম ক্র্যাক বা ফাটল সৃষ্টি হয়। হঠাৎ গরম, হঠাৎ ঠান্ডা খাওয়ার ফলে এনামেল কিছুটা প্রসারিত হয় বা বেড়ে যায় এবং ফাটল ধরে। সুতরাং গরম খাবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা খাবার খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
৫. ভুল টুথপেস্ট ব্যবহার : দাঁতের সুস্থতার জন্য সবসময় অতিরিক্ত কর্কশ বা রুক্ষ টুথপেস্ট ব্যবহার করা উচিত নয়। অনেক ধরনের বিজ্ঞাপনেই বলা হয় টুথপেস্টের মধ্যে আছে এমন কিছু পদার্থ যা আপনার দাঁত রাতারাতি ঝকঝকে সাদা করে দিতে সক্ষম। এ ধরনের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে যারা এই পেস্ট ব্যবহার করবেন, তাদের দাঁত অতি তাড়াতাড়ি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হয়ে টুথপেস্ট ব্যবহারে সবসময় ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা ভালো।
৬. দাঁত দিয়ে বোতলের ছিপি খোলার অভ্যাস : অনেকেই দাঁতের শক্তি দেখানোর জন্য দাঁত দিয়ে কোল্ড ড্রিংকসের বোতলের ছিপি খোলার চেষ্টা করেন, তেমনি দাঁত দিয়ে শক্ত কিছু ভেঙে কৃতিত্ব নিতে চান। আসলে দাঁত আমাদের জন্য প্রয়োজন সৌন্দর্যে, শব্দ উচ্চারণে আর খাদ্যদ্রব্যকে পিষিয়ে পাকস্থলীতে পাঠানো। অন্য কিছু কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। এ ধরনের বোতলের ছিপি খোলার কারণে অনেক সময় দাঁত ভেঙে যায়, ফেটে যায় ও ফাটল ধরে। পরবর্তী সময়ে তার চিকিৎসা জটিলতা ছাড়াও ব্যয়ও কিন্তু বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে কমে যায় দাঁতের আয়ু।
৭. নিয়মিত দাঁত ব্রাশ ও ফ্লসিং না করা : প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা সকালে নাস্তার পর ও রাতে ঘুমানোর আগে অন্তত ৩ থেকে ৪ মিনিট দাঁত ব্রাশ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দাঁতের ফাঁক থেকে ময়লা বা খাদ্যকণা বের করে আনার জন্য ডেন্টাল ফ্লস (এক ধরনের সিল্ক সুতা) ব্যবহার করা ভালো। যদি আপনার কর্মস্থলে দাঁত ব্রাশ না থাকে, তাহলে বাসার মতো করে সেখানেও একসেট টুথব্রাশ, পেস্ট ও ফ্লস রাখুন। কারণ অনেক সময় অফিসেই নাস্তা বা মধ্যাহ্ন ভোজন বা রাতের আহার সারতে হয়। তখন সেখানেও যাতে দাঁত ব্রাশ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখাটাও জরুরি। তবে ব্রাশের আগে অবশ্যই ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করবেন, পরে নয়। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ ও ফ্লস না করলে সহজেই দাঁতের গর্ত বা ক্যাভিটি হয় এবং ব্যথা ও প্রদাহ থেকে আরো জটিলতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং দাঁত ব্রাশ ও ফ্লস করা প্রয়োজন প্রতিদিন অন্তত দুবার ।
৮. বছরে অন্তত একবার দাঁত পরীক্ষা করা : বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিয়মিত বছরে অন্তত একজন অভিজ্ঞ ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে দাঁতের স্কেলিং করানো যেমন জরুরি, তেমনি দাঁতগুলো পরীক্ষা ও সেই সঙ্গে মুখের বিভিন্ন অংশের পরীক্ষা করানোও জরুরি। তাতে মুখ ও দাঁতের সামান্য গর্তকে ফিলিং করিয়ে যেমন রক্ষা করা যাবে, তেমনি একটি প্রি-ক্যানসার ঘা বা প্রদাহকে ক্যানসারের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যাবে। অতএব প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর- প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।
অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী