• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভেষজশিল্পে নতুন আশা

আফাজ পাগলা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

স্বাস্থ্য

ভেষজশিল্পে নতুন আশা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

বিশ্বব্যাপী ভেষজ ওষুধের বাজার দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করছে। প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে আন্তর্জাতিক বাজারে ভেষজের চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি ভেষজ উপাদানের চাহিদা আমাদের দেশেও গত পাঁচ বছরের তুলনায় পাঁচগুণ বেড়েছে। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বেড়ে চলেছে। ভেষজ উৎপাদনে বাংলাদেশের চমৎকার সহায়ক প্রাকৃতিক পরিবেশ উপযোগী। আমাদের দেশে রয়েছে উর্বর জমি, পর্যাপ্ত পানি ও অনুকূল আবহাওয়া। দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও ওষুধশিল্পে বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ১০০ প্রকারের ভেষজ। দেশের বাজারে ভেষজ উদ্ভিদ থেকে দেড় শতাধিক ওষুধ উৎপাদন করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগ এখনো ভেষজ ওষুধের উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। উপাত্ত বলছে, পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ ওষুধ ভেষজ উদ্ভিদ থেকে তৈরি হচ্ছে। অণুুজীব উদ্ভূত ৬০ শতাংশ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুত হয় ভেষজ উদ্ভিদ থেকে। রাশিয়ায় প্রস্তুত ও ব্যবহূত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের শতকরা ৪৭ শতাংশের বেশি ভেষজ উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা হয়।

আশার খবর হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ ও উৎপাদন শুরু হয়েছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ওষুধ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিউটি পার্লার ও প্রসাধনশিল্পে প্রচুর পরিমাণে ভেষজ উপাদান ব্যবহার হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার উদ্ভিদের মধ্যে প্রায় ৬০০ প্রজাতি ঔষধি বা ভেষজ উদ্ভিদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০৫০ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ভেষজের বাণিজ্য হবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার। এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ভেষজ ওষুধ ও ঔষধি উপাদান রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে ভেষজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ভেষজ সামগ্রী আমদানি করা হয়।  গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ওষুধশিল্পে বর্তমানে যে পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহূত হয় তার ৭০ ভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।

ডেবটেকের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪২২টি আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি প্রতিষ্ঠান ওষুধ উৎপাদনে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আবুধাবি, চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সব দেশেই ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

ভেষজ উদ্ভিদের প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে— যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, পাকিস্তান, কোরিয়া। বর্তমানে বিশ্বে ভেষজ বাজার ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১.৩ ও জার্মানিতে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ভেষজ ওষুধ বিক্রি হয়। ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করে চীন প্রতিবছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার কোটি রুপি এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই ভারত ও চীনের দখলে।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে বিশ্বে শুধু ভেষজ উদ্ভিদের বাজার রয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই এখন ভারত ও চীনের দখলে।

ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যেকোনো ফসল উৎপাদনের চেয়ে অধিক লাভজনক, নিরাপদ ও সহজ হওয়ার কারণে সমগ্র বিশ্বে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। 

আফাজ পাগলার ভেষজ বিপ্লব : রাজশাহী অঞ্চলের নাটোরে খোলাবাড়িয়া গ্রামের এক বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ পাগলা বাড়ির পাশে ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করেন। এই ঘৃতকুমারীরর গাছই বদলে দিয়েছে গ্রামটির নাম। বদলে দিয়েছে গ্রামের আর্থিক অবস্থা। খোলাবাড়িয়া এখন ঔষধি গ্রাম নামেই অধিক পরিচিত। প্রায় এক দশক আগে সেই আফাজ পাগলার ঘৃতকুমারীর চারা রোপণ বদলে দিয়েছে গ্রামবাসীর দৃষ্টিভঙ্গিও। ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা-চেতনা এবং কর্ম। গ্রামের ১৬শ পরিবার এখন ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের চারপাশে বিঘার পর বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষাবাদ। যাদের জমিজমা নেই তারাও বাড়ির আঙিনায় চাষ করছেন ঘৃতকুমারী। এই গ্রামে মোট ২৫ হেক্টর জমিতে ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। আশ্চর্য এই ঔষধি গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রির দোকান। শুধু নামে ঔষধি গ্রাম নয়, গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম এখন ভেষজ চাষাবাদ।

বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে ‘ভেষজ বহুমুখী সমবায় সমিতি’। সমিতির মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা আর উৎপাদনকারীর সমন্বয়ে জমে উঠেছে ভেষজ বিপ্লব। আফাজ পাগলার ভেষজ প্রেমের অনুসারী হয়ে গ্রামের সবাই এখন ভেষজচাষি। গ্রামের নারীরা এই কাজে অনেক এগিয়ে। ঔষধি চাষাবাদের জন্য এ গ্রামের নারীদের বলা হয় ‘বনজরানী’। এই গ্রামের মাটিরও নাম দেওয়া হয়েছে ভেষজ মাটি। আফাজ পাগলের ১৭ কাঠার চাষি জমিতে ৪৫০ প্রজাতির ভেষজ নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রামে এরকম আরো আছে ৮টি নার্সারি। এসব নার্সারিতে আছে বাসক, সাদা তুলসী, উলট কম্বল, চিরতা, নিম, কৃষ্ণতুলসী, রামতুলসী, ক্যাকটাস, সর্পগন্ধা, মিশ্রিদানা, হরীতকী, লজ্জাবতীসহ হরেক রকমের ঔষধি গাছ। গ্রামটিতে ৫০০ কৃষক সব সময় ভেষজ চাষাবাদ করেন।

কৃষকদের স্বার্থে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ভেষজ গাছ-গাছড়া উৎপাদন সমবায় সমিতি’। জানা গেছে দেশে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঔষধি কাঁচামালের স্থানীয় বাজার রয়েছে। এই ঔষধি গ্রামই এ চাহিদার অধিকাংশের জোগান দেয়। স্কয়ার ও এসবি ল্যাবরেটরিজের মতো প্রতিষ্ঠান এখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। ঔষধি গ্রামের এই ভেষজ চাষাবাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতেও। এ যেন এক ভেষজ বিপ্লব কাহিনী। এই যে ভেষজ বিপ্লব তার পেছনে নেপথ্য নায়ক একজনই। আফাজ পাগল। গ্রামজুড়েই এখন ভেষজ পাগল আর পাগল। যে যত বেশি পাগল সে তত বড় কবিরাজ। সব কবিরাজের গুরু আফাজ পাগল। আফাজই পথ দেখিয়েছে অন্যদের। উৎসাহ দিয়েছে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছে এমনকি সহযোগিতাও করেছে ভেষজ চাষাবাদে। এখন সবাই একই পথের পথিক।

বাংলাদেশে বোধকরি এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে সব মানুষ একই পেশায় নিয়োজিত। ভেষজ গাছ-গাছড়ার চাষাবাদে আফাজ পাগলের এই দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুসরণীয় হোক। ‘ঔষধি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের ২৪ গ্রাম। এসব এলাকার প্রায় ২৫ হাজার বাঙালি-আদিবাসী তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে দিন-রাত খেটে যাচ্ছে ঔষধি গাছের নার্সারি ও চারা রোপণ করে। এ কারণে পাহাড়ি জনতার ভাগ্যোন্নয়নে এলাকায় ‘ঔষধি গাছ’ এখন একটি আলোচিত নাম। বিলুপ্ত প্রায় গাছকে রোপণ করে গারো পাহাড়ের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে এবং পাহাড়ের অবহেলিত আদিবাসী-বাঙালিদের জীবনমান উন্নয়নে ২০০৮ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি সংগঠন ‘সোসাইটি ফর বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন’ (এসবিসি)। এসবিসি ২০০৮ সাল থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি গ্রামসহ সীমান্তবর্তী ৪ ইউনিয়ন কাংশা, নলকুড়া, ধানশাইল ও গৌরীপুরের ২৪ গ্রামে ৩৭টি কৃষকমৈত্রী সংগঠনের মাধ্যমে ঔষধি গাছ রোপণ ও চারা তৈরি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ফলে বর্তমানে ওই সব গ্রাম এখন ‘ঔষধি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ ছাড়া পঞ্চগড়ে মীন হারবাল, সোনারগাঁয়ে হামদর্দের ভেষজ বাগান উল্লেখযোগ্য। মানিকগঞ্জ, সাভার, ফরিদপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, দিনাজপুর খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানসহ অনেক জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ নতুন করে আশা জাগাচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads