• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
 কিডনি রোগে হোমিও চিকিৎসা  ও বিবিধ প্রসঙ্গ

সংগৃহীত ছবি

স্বাস্থ্য

কিডনি রোগে হোমিও চিকিৎসা ও বিবিধ প্রসঙ্গ

  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৯

মূত্রযন্ত্রের এবং মূত্রের যে কোনো পীড়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রথমে যন্ত্রটি সম্পর্কে আমাদের একটি সঠিক ধারণা থাকতে হবে। মূত্রযন্ত্রটিকে প্রধান চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— ১. দুইটি কিডনি যা মূত্র নিঃসৃত করে থাকে, ২. দুটি মূত্রবাহী নালি বা ইউরেটারস যা প্রস্রাবকে কিডনি থেকে নিচে নিয়ে যায়। ৩. একটি মূত্রস্থলী বা ইউরিনারি ব্লাডার যেখানে মূত্র সঞ্চিত থাকে। ৪. মূত্রনালি বা ইউরেথ্রা যা দিয়ে প্রস্রাব বেরিয়ে আসে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি একটি যোনি বহিঃইন্দ্রীয় এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে একটি ছিদ্র।

মূত্রযন্ত্রের অংশগুলো- ১. লেফট কিডনি, ২. রাইট কিডনি, ৩. এয়োর্টা, ৪. ইনফিরিয়ার ভেনা কেভা, ৫. লেফট ইউরেটার, ৬. রাইট ইউরেটার, ৭. ইউরিনারি ব্লাডার ও ৮. ইউরেথ্রা। উল্লেখ্য, ডান কিডনি বাঁ দিকের কিডনি থেকে একটু নিচে থাকে। তার কারণ ডান দিকের কিডনির ওপর লিভার থাকে। প্রতিটি কিডনি লম্বায় প্রায় ৪/৫ ইঞ্চি এবং প্রান্তেই আড়াই ইঞ্চি। একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের কিডনির প্রতিটির ওজন হয় প্রায় ১৪০ গ্রাম। কিডনির আকৃতি অনেকটা বরবটির ভেতরের দানার মতো। ডান দিকের কিডনির সামনে থাকে লিভার বৃহৎ অন্ত্র, ডিওডেনাম এবং ক্ষুদ্রান্ত্র। বাম দিকের কিডনি সামনে থাকে প্লীহা, প্যানক্রিয়াস, পাকস্থলীর অংশ, ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহৎ অন্ত্র।

বর্তমান বাংলাদেশে ২ কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রায় ৭৫ শতাংশ কিডনি বিকল হওয়ার পর রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। প্রতি বছর কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে মারা যাচ্ছেন ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ। অথচ গণসচেতনতা বৃদ্ধি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ৬০ শতাংশ কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আমরা অনেকেই জানি না যে, আমরা যত ওষুধ খাই তার অধিকাংশই রক্তে প্রবেশ করে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে রক্ত থেকে সংগ্রহ করে ছেঁকে ছেঁকে শরীর থেকে বের করার দায়িত্ব পালন করতে হয় কিডনি দুটিকে। ফলে আমরা যত বেশি ওষুধ খাই, আমাদের কিডনিকে তত বেশি পরিশ্রম করতে হয় এবং ফলে কিডনি দুটি তত বেশি দুর্বল-ক্লান্ত-শ্রান্ত-অসুস্থ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া বেশি বেশি ওষুধ খেলে তাদের শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হয়।

উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস আমাদের কিডনরি যতটা ক্ষতি না করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে এসব রোগ চিকিৎসার নামে যুগের পর যুগ খাওয়া মারাত্মক ক্ষতিকর অ্যালোপ্যাথিক কেমিক্যাল ওষুধগুলো। বিশেষ করে যেসব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ মানুষ বেশি বেশি খায় (যেমন-অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথার ওষুধ, বাতের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, ব্লাড প্রেসারের ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি), এগুলো কিডনির এতই ক্ষতি করে যে, এদেরকে কিডনির যম বলাই উচিত। একটি বাস্তব সত্য কথা হলো, প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ কখনো সারে না; বলা হয় এগুলো ‘নিয়ন্ত্রণে থাকে’। আসল কথা হলো, কোনো ওষুধ যখন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ খাওয়া হয়, তখন সেই ওষুধ আর রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বরং রোগই সেই ওষুধকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। ফলে এসব কুচিকিৎসায় ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ তো সারেই না বরং দিন দিন আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মাঝখানে মারাত্মক মারাত্মক ওষুধের ধাক্কায় কিডনির বারোটা বেজে যায়। অথচ একজন বিশেষজ্ঞ হোমিও ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসা নিলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং নেফ্রাইটিস দুয়েক বছরের মধ্যেই কেবল নিয়ন্ত্রণ নয় বরং একেবারে নির্মূল হয়ে যায়। কেননা হোমিও ওষুধে যেহেতু ওষুধের পরিমাণ থাকে খুবই কম, সেহেতু এগুলো কয়েক যুগ খেলেও কিডনিতে জমে কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নাই। হ্যাঁ, অন্যান্য রোগের মতো কিডনি রোগের চিকিৎসাতেও হোমিও ওষুধ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কারণ প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে কিডনি রোগের কষ্টগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও কিডনি রোগের পেছনের মূল কারণসমূহ দূর করা যায় না।

একমাত্র হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমেই কেবল কিডনি রোগের পেছনের মূল কারণসমূহ দূর করা সম্ভব হয় এবং এভাবে একই রোগ কয়েক বছর পরপর ঘুরেফিরে বারবার ফিরে আসা ঠেকানো যায়। কিডনি নষ্ট হওয়ার কারণে যারা ডায়ালাইসিস করে বেঁচে আছেন, তারাও ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করে তাদের বিকল কিডনিকে ধীরে ধীরে সচল করে তুলতে পারেন। হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিতে বংশগত রোগ প্রবণতার ইতিহাস এবং শারীরিক-মানসিক গঠন, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, উজ্জীবিত হয়। ফলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নষ্ট কিডনি আবার ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিডনি পুরোপুরি ভালো না হলেও যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার ফলে ডায়ালাইসিসের সংখ্যা কমানো যায়। যেমন— দেখা যায় যেই রোগীর প্রতি সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করতে হতো, তার হয়তো এখন পনেরো দিনে বা মাসে একবার ডায়ালাইসিস, আর কিডনি পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যায়। অথচ প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসায় একবার ডায়ালাইসিস শুরু করলে কিডনি না পাল্টানো পর্যন্ত আর সেটি বন্ধ করা যায় না। বরং যত দিন যায় ডায়ালাইসিস তত বেশি ঘন ঘন করতে হয়।

সাধারণত কিডনি রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগের ভয়াবহতার মাত্রা এবং রোগের পেছনের অন্তর্নিহিত কারণ অনুযায়ী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করা যায়। কিন্তু প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে কিডনি রোগের চিকিৎসা প্রায় সারা জীবনই চালিয়ে যেতে হয়। নষ্ট কিডনি প্রচলিত অন্যান্য চিকিৎসায় কখনো ভালো হয় না। কারণ তাদের টার্গেট হলো কিডনিকে ভালো করা নয় বরং কৃত্রিম উপায়ে কিডনির কাজ অন্যভাবে চালিয়ে নেওয়া (যেমন— ডায়ালাইসিস করা এবং কিডনি পাল্টানো)।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মায়াজমেটিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এতে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে অকল্পনীয়। যেমন— হোমিও চিকিৎসায় কিডনির ধ্বংস হওয়া কোষতন্তুর জায়গায় ভালো টিস্যু গজাতে দেখা যায়। সাধারণত কিডনি পাল্টানোর পরে অনেক ক্ষেত্রে কিডনি গ্রহীতার শরীর এই নতুন কিডনিকে গ্রহণ করতে চায় না, নতুন কিডনিকে সে প্রত্যাখ্যান করে। নতুন কিডনিকে প্রত্যাখ্যানের এই হার বেশ উচ্চ। রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় ছাড়া অন্যদের কিডনি গ্রহণ করলে এসব বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে নতুন কিডনির বিরুদ্ধে শরীরের এই বিদ্রোহকে সামাল দিতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়; অথচ এসব ক্ষেত্রে অপারেশনের পূর্ব থেকেই (অথবা অপারেশনের পরেও) যদি হোমিও চিকিৎসা অবলম্বন করা হয় তবে অন্তত একশগুণ কম খরচে বিদ্রোহ সামাল দেওয়া সম্ভব।

নতুন কিডনি সংযোজনের পরে অনেক সময় দেখা যায় কিডনির সঙ্গে সম্পর্কিত রোগের (যেমন— ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদির) মাত্রা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপের মতো কিডনির সঙ্গে সম্পর্কিত রোগসমূহ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় যে কত সহজে দমন করা যায়, তা পূর্বেই বলেছি। কিডনি রোগীদের পাশাপাশি যাদের কিডনি রোগ নাই কিন্তু ফ্যামিলিতে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে, তাদের উচিত প্রতিরোধমূলক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ে কিডনি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা। কারণ একজন দক্ষ হোমিও ডাক্তার যে কোনো মানুষের সামগ্রিক ইতিহাস শুনলে অদূর অথবা দূর ভবিষ্যতে তার কী কী রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তা বুঝতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করে তাকে সে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারেন। যারা জন্মের পর থেকেই একজন হোমিও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসার অধীনে থাকেন, তাদের কিডনি নষ্ট হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নাই। আবার যেসব ডায়াবেটিস রোগী একই সাথে উচ্চরক্তচাপেও ভুগছেন, তাদের কিডনি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করা।

হোমিও সমাধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ডা. হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হোমিওপ্যাথিসহ যে কোনো জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক লক্ষণ সমষ্টিনির্ভর ও ধাতুগতভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।

লেখক: ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads