• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

স্বাস্থ্য

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

পরিবার হলে সচেতন ডায়াবেটিস হবে নিয়ন্ত্রণ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০১৯

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ডায়াবেটিস একটি শারীরিক অবস্থা যা সারা জীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হয়। একসময় ডায়াবেটিসকে বড়লোকের রোগ ভাবা হতো। তবে এখন সব বয়স আর শ্রেণির মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বলা বাহুল্য, বর্তমানে সব বয়সী মানুষের মধ্যেই এ রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।  সারা বিশ্বে এর কারণে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ হলো ডায়াবেটিস। আর অপরিকল্পিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে এই রোগটি মহামারী আকারে ধারণ করেছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। তবে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ডায়াবেটিস বিস্তার রোধ করতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অভিমত প্রকাশ করেন। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক যেসব মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশের। কারণ সেসব দেশে খুব দ্রুত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে।

ডায়াবেটিস একটি অসংক্রামক ব্যাধি। পারিবারিক ইতিহাস, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, কায়িক শ্রমের ঘাটতি, শরীরের অতিরিক্ত ওজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা তথা সার্বিক জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিসের যোগসূত্র রয়েছে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডায়াবেটিসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম না করা। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হওয়ার কারণ, তারা সংসারের কাজ, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ করলেও নিজের দিকে নজর  দেন না। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় এ রোগে আক্রান্ত হন। ডায়াবেটিসের কারণে বেড়ে যাচ্ছে অন্ধত্ব, স্নায়ুরোগ, কিডনি ও হূদযন্ত্র বিকল হওয়া, পায়ে আলসার এবং পরিণামে পা কেটে ফেলতে বাধ্য হওয়ার মতো ভয়াবহ জটিলতা। অসংখ্য মানুষ নিজেদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলার কারণে পরিবারের ও সমাজের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সমাজ হারাচ্ছে কর্মক্ষম ও সম্ভাবনাময় প্রজম্মকে। এ ছাড়া এই রোগের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব গোটা জাতিকে স্থবির করে দিতে পারে।

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়া এই রোগীদের জন্য ইনসুলিন জোগানের সংকট সৃষ্টি হবে বলে এক গবেষণায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৪০ কোটি ৬০ লাখ। আর ২০৩০ সালে ৫১  কোটি ১১ লাখে দাঁড়াতে পারে। ১৪ নভেম্বর ইনসুলিনের আবিষ্কারক ফ্রেডারিক ব্যান্টিং স্যাঙ্গারের জম্ম দিনে পালিত হয় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। হু বুলেটিনে প্রকাশিত গবেষণার মতে, বাংলাদেশের ৭.১ মিলিয়ন মানুষ এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত। ২০৪০ সালে এর সংখ্যা ১৩.৬ মিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হয়। ভয়ের ব্যাপারটি হচ্ছে ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বা ৫১.২% মানুষ, ভালো রাখেন না এবং ঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে, বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়ার পর থেকে টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের মধ্যে এই ঝুঁকি তৈরি হয় তাদের ২৫ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন বলছে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। কিন্তু যারা আক্রান্ত তাদের ৫৭ শতাংশই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। বাংলাদেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটোই প্রয়োজন। একজন রোগীর যদি প্রতি মাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতি মাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪০০ কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

 

বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে

রক্তের সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াকে বলে ডায়াবেটিস। তবে ডায়াবেটিস ছাড়াও প্রিডায়াবেটিস বা বর্ডারলাইন ডায়াবেটিস নামক আরেকটি সমস্যা রয়েছে যা সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঠিক আগের অবস্থাকে বলা বর্ডারলাইন ডায়াবেটিস। টাইপ-টু ডায়াবেটিসের আগে সাধারণত এই অবস্থাটি তৈরি হয়। বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসের প্রাথমিক চিহ্ন অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমতে শুরু করলে সেটাকে বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসের চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া আপনার যদি শারীরিক স্থূলতা, রক্তচাপ বেশি, দৈনন্দিন কাজের পরিমাণ কম হয়, সন্তান জন্ম দিলে তার ওজন ৯ পাউন্ডের কম হয়, কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, পরিবারের অন্য কারো টাইপ-টু ডায়াবেটিস থেকে থাকে সেক্ষেত্রে বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসে একজন ব্যক্তির রক্তে সুগারের পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি।

আবার এই পরিমাণটা এতটাও বেশি নয় যে তাকে ডায়াবেটিস বলা যায়। এই সময় আমাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি করে, তবে সেটা খুব বেশি কার্যকরীভাবে কাজ না করতে পারায় রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে ব্যাপারটি এমন নয় যে বর্ডারলাইন ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস হবেই। তবে স্বাভাবিক ব্যক্তির চাইতে বর্ডারলাইন ডায়াবেটিসে ভুগছেন এমন ব্যক্তির টাইপ-টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৫ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি থাকে। নিয়মিত কিছু পদ্ধতি অনুশীলন না করলে এই পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।

 

রোজা বা উপবাসে ডায়াবেটিস নিরাময়

মার্কিন বিজ্ঞানীদের একটি দল তাদের ২০১৭ সালে এক গবেষণার ফল থেকে সেরকম আশার আলো দেখতে পান। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখতে পান উপবাস করে এবং একটি নির্দিষ্ট ডায়েট বা খাদ্যতালিকা অনুসরণ করে অগ্ন্যাশয়ের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মূলত ইঁদুরের ওপর এই ‘ফাস্টিং ডায়েট’-এর পরীক্ষা চালান বিজ্ঞানীরা। এতে দেখা যায়, ইঁদুরকে উপবাসে রেখে যখন তাকে খাবার দেওয়া হয় তখন তা ইঁদুরের অগ্ন্যাশয়ে এক ধরনের ‘বেটা সেল’ পুনরুৎপাদনে সাহায্য করে। রক্তপ্রবাহে যখন চিনি বেড়ে যায়, তখন অগ্ন্যাশয়ের এই ‘বেটা সেল’ তা শনাক্ত করতে পারে এবং ইনসুলিন নির্গত করার মাধ্যমে তা প্রশমিত করে। গবেষক দলের একজন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ড. ভ্যাল্টের লোঙ্গো বলেন, গবেষণা থেকে আমরা যে উপসংহারে পৌঁছেছি তাহলো, ইঁদুরকে যখন উপবাসে রেখে কাহিল করে ফেলা হচ্ছে এবং তারপর আবার খাবার দেওয়া হচ্ছে, সেটি তাদের অগ্ন্যাশয়কে পুনরায় কর্মক্ষম করে তুলছে। অগ্ন্যাশয়ের সেলগুলো এর ফলে এই অঙ্গের অকেজো অংশকে আবার সচল করে তুলছে।

 

নিয়ন্ত্রণে চাই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ সাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনিজাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।

খেতে হবে স্বাস্থ্যকর খাবার- শাকসবজি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল। একবারে পেট ভরে না খেয়ে পরিমাণে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া উত্তম। শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রখা সম্ভব। মোটকথা আপনাকে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ধূমপান পরিহার করাও জরুরি। নজর রাখতে হবে কোলেস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হূদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

 

নিরাময়ে জার্মানির অভিনব উদ্যোগ

জার্মানিতে প্রায় ৬০ লাখ ডায়াবেটিসের রোগী রয়েছেন। প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক মানুষ সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় এক গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ওজন কমিয়ে ডায়াবেটিসের মোকাবেলা করা সম্ভব বলে তারা দাবি করেছেন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. মাটিয়াস রিডেল বলেন, ‘আমার কাছে এটা একটা মাইলফলক। এটা স্পষ্ট, ডায়াবেটিস নিরাময় করা সম্ভব।

আগের মতো এই রোগকে আর নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে হবে না।’ ইংল্যান্ডের এই গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, রোগ দেখা দেওয়ার পর প্রথম ৬ মাসের মধ্যে শুধু ওজন কমিয়ে সেটি নিরাময় করা সম্ভব। তাতে কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। এক পরীক্ষার আওতায় খাদ্য তালিকার অত্যন্ত কড়া নিয়ম অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের খেতে দেওয়া হয়েছিল। তিন মাস ধরে তাদের দিনে শুধু ৯০০ ক্যালোরি পরিমাণ নিউট্রিশন শেক খেতে হয়েছে। সেইসঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা তাদের পরামর্শ দিয়েছেন। বেশ কিছু ব্যায়ামও করতে হয়েছে। তার ফল ছিল বেশ চমকপ্রদ।

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চা

ডায়াবেটিস কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে খেতে পারেন করলা চা। করলার চা তৈরিতে করলার পাতা, বীজ বা ফল ব্যবহার করা যেতে পারে।

করলার চা আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে ও ইমিউনিটি এবং দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এটি রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, লিভার পরিষ্কার করে, ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে এই করলা। শুকনো করলার টুকরাকে পানিতে ভিজিয়ে চা তৈরি করে এবং ওষুধ হিসেবে বিক্রি হয়। এটি গুঁড়ো বা নির্যাস হিসেবেও বাজারে পাওয়া যায়। এই চা করলার পাতা, ফল এবং বীজ দিয়েও তৈরি করা যায়। তবে হাইপোগ্লুইসেমিয়া রোগীর ক্ষেত্রে করলার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই করলার চা আপনার প্রতিদিনের ডায়েটে ব্যবহার করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads