• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
আশায় দিন কাটছে আবাসন ব্যবসায়ীদের

ফাইল ছবি

আবাসন

আশায় দিন কাটছে আবাসন ব্যবসায়ীদের

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

চলতি অর্থবছরের ৬ মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাজেট ঘোষণাকালে আবাসন খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে ৬ মাসে দৃশ্যমান কিছুই পায়নি এই খাত। এখনো আশায় দিন যাচ্ছে এই খাতের ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার বেসরকারি খাতবান্ধব। সুতরাং এই খাতও সুফল পাবে। আমরা ভালো কিছু পাবার প্রত্যাশায়। এমন প্রেক্ষাপটে রাজধানীতে শুরু হচ্ছে ৫ দিনব্যাপী আবাসন মেলা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আবাসন খাত অগ্রাধিকার পাবে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাটে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন ব্যয় কমবে।  তবে মাশুল, সম্পদ কর, স্ট্যাম্প ডিউটি, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এবং স্থানীয় সরকার কর কিছুই কমেনি।

অবশ্য আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাগজ) বলেন, নীতিনির্ধারণী কিছু সমস্যার কারণে আবাসন খাত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সংকটময় অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে এই খাত বেরিয়ে আসছে। ফলে চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবিরা ৫ শতাংশ সুদে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, এখনো উচ্চ নিবন্ধন ব্যয়, সকল নাগরিকের জন্য দীর্ঘমেয়দি ঋণের ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চ সুদের কারণে এই খাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আমরা জেনেছি প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই হয়তো বাস্তবায়ন হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসন খাতে সাধারণ মানুষের জন্য নতুন কিছু না থাকলেও কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে। নতুন করে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে জমি কেনায়। আর ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকা বিনিয়োগে করহার কমানো হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই অর্থের উৎস সম্পর্কে রাজস্ব বিভাগ থেকে প্রশ্ন তোলা হবে না। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এসব বিষয়ে নিয়ে নিয়তিম প্রশ্ন তুলছে। ফলে আবাসন খাত সচল করা যাচ্ছে না। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী নিবন্ধন মাশুলসহ অন্যান্য মাশুল কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আবাসন খাতে দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা চলছে। খাতটি বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ স্ট্যাম্প ও নিবন্ধন মাশুল অনেক বেশি। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব মাশুল যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আকাশছোঁয়া দামের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনাটা এখন স্বপ্নের পর্যায়ে চলে গেছে। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা গেলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাই বাজেটের আগে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করার দাবি করেছিল আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।

সংগঠনটি বলেছিল, গৃহঋণের জন্য তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে রি-ফাইনান্সিং ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে সাধারণ মানুষ ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় দেড় হাজার বর্গফুট বা তার চেয়ে ছোট ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ঋণ নিতে পারে। এ ছাড়া হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনকে একটি তহবিল দেওয়ার সুপারিশ করেছিল তারা। সেটি হলে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ ৬-৭ শতাংশ সুদে ৩০ বছরের জন্য গৃহঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে পারতেন।

ফ্ল্যাট ও প্লটের নিবন্ধন মাশুল, সম্পদ কর, স্ট্যাম্প মাশুল, স্থানীয় সরকার কর ও ভ্যাট ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল রিহ্যাব। তারা বলেছিল, রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অত্যধিক হওয়ায় ফ্ল্যাট ও প্লট নিবন্ধনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ক্রেতারা। সার্কভুক্ত অন্য দেশে রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ৪ থেকে ৭ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ তা ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে ফ্ল্যাট ক্রয়ে কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে নতুন করে কর কমানো হয়েছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় ২০০ বর্গমিটারের কম ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক জায়গা কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৪ হাজার টাকা এবং ২০০ বর্গমিটারের বেশি ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক জায়গা কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর জমি কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে। এত দিন গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় এলাকায় ২০০ বর্গমিটারের বেশি ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক জায়গা কিনতে প্রতি বর্গমিটারে ৭ হাজার টাকা কর দিতে হতো। এসব এলাকায় ২০০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক জায়গার ক্ষেত্রে কর ছিল প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার টাকা। অন্যান্য এলাকায় একইভাবে কর কমানো হয়েছে।

এ নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, করহার বেশি হওয়ায় খুব একটা সাড়া মিলছে না। তাই করহার হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, হ্রাসকৃত করহারের সুযোগ নিয়ে করদাতারা ফ্ল্যাট ক্রয় ও দালান নির্মাণে তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা আবাসন সমস্যা সমাধানে এই খাত সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আসা জরুরি। দিতে হবে নীতি সহায়তা। প্লট কিংবা ফ্ল্যাট কিনতে যাতে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলা না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, অর্থ পাচার বাড়বে। সেকেন্ড হোম গ্রহণের সুযোগ নিতে অনেকে অর্থ পাচার করবে।

সরকারি বেসরকারি হিসাব বলছে, মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপিতে আবাসন খাতের সরাসরি অবদান ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পের অবদান যোগ করলে জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ১২ শতাংশের ওপরে। একই সঙ্গে ৩৫ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এই খাত। যাদের ওপর নির্ভরশীল ২ কোটি মানুষ। সরকারের সঠিক নীতি সহায়তা পেলে এই খাতের আরো প্রসার ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্র বলছে, দেশে ঝুঁকিমুক্ত, পরিবেশবান্ধব একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা জরুরি। বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। আবাসন খাতের ব্যবসায়দের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাবের একটি হিসাব বলছে, গত তিন দশকে দুই লক্ষের বেশি ফ্ল্যাট গ্রাহককে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর প্রায় এক লক্ষ প্লট গ্রাহকদের দেওয়া হয়েছে। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রশ্ন। সরকার এই খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে এলেও বিভিন্ন সংস্থা পরে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের প্রশ্নের মুখে ফেলছে। তাদের ব্যাংক হিসাব, টাকার উৎস জানতে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তাই গ্রাহকদের একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য অর্থের উৎস প্রদর্শন যাতে না করতে হয় তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য আয়কর অধ্যাদেশের ১৯-এর বি পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। এটি করা না হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাবে। এই খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য ভবিষ্যতে যাতে কোনো সংস্থা প্রশ্ন না তুলতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে ভয় থেকে অনেকে বিদেশে সেকেন্ড হোম গ্রহণের সুযোগ নিয়ে অর্থ পাচার করছে।

সূত্র বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক থেকে দেশে ফ্ল্যাট ও প্লট বেচাকেনার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এতে করে এই খাতে এক ধরনের বৈরী পরিবেশ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, যা বন্ধ করতে হবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নথি জব্দ করছে। এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। 

সূত্রগুলো বলছে, নানাবিধ কারণে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরে মানুষ বাড়ছে। নগরমুখী মানুষের এই স্রোত সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকাতে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ নগরবাসী ছিল। ২০১১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশের নগরায়ণের হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নগরীর মধ্যে ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ছে সবচেয়ে বেশি হারে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন অন্যতম। জাতিসংঘের তৈরি ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন  প্রসপেক্টাস : দ্য ২০১৪ রিভিসন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের ষষ্ঠ জনবহুল নগরী। আর শহরমুখী মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একটি ফ্ল্যাট বা প্লট নিয়ে থাকার আগ্রহ বাড়ছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও পরিকল্পিত বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। প্রতিটি নাগরিক যাতে ভাড়ার টাকায় অন্তত তাদের একটি ঠিকানা খুঁজে পায় সেদিকে লক্ষ্য এবার।

সরকারের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান, রড, সিমেন্ট, টাইলসসহ ২৬৯ প্রকার লিংকেজ শিল্প এই খাতের সঙ্গে জড়িত। এই খাতগুলোর প্রসারের মাধ্যমে সমগ্র নির্মাণ খাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। দেশের জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ৭ শতাংশ। সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন বাজেটে এই খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ও নীতি সহায়তার ঘোষণা আসতে পারে। এতে করে গতি সঞ্চার হবে এই খাতে। বাড়বে গ্রাহকের উৎসাহ। দশ তলার ওপরে একটি ভবন নির্মাণ করতে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, ডিএমপি, পরিবেশ অধিদপ্তর, তিতাস, ডেসকো, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, সিভিল এভিয়েশনসহ মোট ১১ প্রতিষ্ঠানের অনুমোাদনের প্রয়োজন হয়। এতগুলো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আবাসন খাতের প্রসারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে, আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে ৫ দিনব্যাপী আবাসন মেলা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মেলার উদ্বোধন করবেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। মেলা চলবে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads