• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
আসামে রাষ্ট্রহীন ১৯ লাখ মানুষ

ছবি : সংগৃহীত

ভারত

আসামে রাষ্ট্রহীন ১৯ লাখ মানুষ

ছয় লাখের বেশি মুসলমান

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গতকাল শনিবার সকাল থেকেই ভারতের আসাম রাজ্যের বাসিন্দাদের চোখ ছিল জাতীয় নাগরিকপঞ্জীকরণের (এনআরসি) সরকারি ওয়েবসাইটে। শনিবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা। নতুন এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩ কোটি ১১ লাখ মানুষ। তবে বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ মানুষ। বাদপড়াদের মধ্যে রয়েছেন ১১ লাখেরও বেশি হিন্দু বাঙালি ও ছয় লাখের বেশি মুসলমান। বাকি দুই লাখের মধ্যে রয়েছেন বিহারি, নেপালি, লেপচা প্রভৃতি। এর আগে গত বছরের ৩০ জুলাই ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ৪০ লাখ আবেদনকারীর নাম।

এদিকে গতকাল সকাল থেকেই আসামে উত্তেজনা ছিল চরমে। সরকারি ওয়েবসাইট www.nrcassam.nic.in or www.assam.mzgov.in লগইন করার হিড়িক পড়ে যায়। ফলে বেশ কিছু সময়ের জন্য সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। অনলাইনে নিজেদের নামের তালিকা দেখতে অগণিত মানুষকে ভিড় জমাতে দেখা যায় সরকার পরিচালিত সেবাকেন্দ্রগুলোর বাইরে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ খবর জানিয়েছে।

তালিকা প্রকাশের পর নাসিরুদ্দিন চৌধুরী নামের এক আবেদনকারী বলেন, আমার সাত বছরের মেয়ে নাজমিন ও আট বছরের ভাতিজা মাসুম তালিকায় ছিল না। এবার তাদের নাম রয়েছে। তালিকা প্রকাশের আগে আমরা আতঙ্কিত ছিলাম, এখন বেশ স্বস্তিতে আছি।

এদিকে এনআরসি থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালি হিন্দু বাদপড়ায় কয়েকজন বিজেপি নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত সপ্তাহে আসামের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইনের কথা বিবেচনা করছে। যার ফলে তালিকায় স্থান পাওয়া বিদেশিদের বাদ দেওয়া যায় এবং বাদপড়া সত্যিকার নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

গত শুক্রবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল জানিয়েছেন, এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদপড়া বাসিন্দারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। তিনি বলেন, আসাম সরকার বাদপড়াদের দেখভাল করবে এবং যাতে করে অপ্রয়োজনীয় হয়রানির শিকার হতে না হয় তা নিশ্চিত করবে।

মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেন, যতক্ষণ আপিল চলবে ততক্ষণ কাউকে বিদেশি বলা যাবে না। কারণ কাউকে বিদেশি বলার এখতিয়ার শুধু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদপড়াদের বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। বাদপড়া ব্যক্তি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন এবং আবেদনের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছে।

তালিকা প্রকাশের পর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা করেই কার্যত নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা রাজ্য। মোতায়েন করা হয়েছে কয়েক হাজার নিরাপত্তা বাহিনী। গুয়াহাটিসহ সমস্ত স্পর্শকাতর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। গুজবে কান না দেওয়ার জন্য আসাম পুলিশ আবেদন করেছে। আসামের উত্তর-পূর্ব দিকের সুরক্ষাও যথেষ্ট আঁটোসাঁটো করা হয়েছে। আসাম পুলিশের তরফ থেকে টুইট করে জানানো হয়েছে, যেসব ব্যক্তি নাম চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে না, তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার।

এদিকে নতুন তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জুনিয়র কমিশনড অফিসার মুহাম্মদ সানাউল্লাহ। দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে কাজ করার পরও তিনি খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন। তখন তাকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করে পাঠানো হয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে। গতকাল প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিতেও মুহাম্মদ সানাউল্লাহর নাম নেই। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলের নামও নেই তালিকায়। কিন্তু সানাউল্লাহর স্ত্রীর নাম তালিকায় আছে।

সানাউল্লাহ একসময় সেনাবাহিনীর সুবেদার ছিলেন। এখন তার বয়স ৫২। ১৯৮৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেন। তিনি দুবার জম্মু-কাশ্মীরে এবং একবার মণিপুরে পোস্টেড ছিলেন। আসাম সরকারের অফিসার চন্দ্রমল দাস তদন্ত করে সানাউল্লাহকে বিদেশি বলে ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালে তাকে নোটিশ দিয়ে বলা হয়, আপনি যে ভারতীয় তা প্রমাণ করুন। ২০১৮ সালে তিনি ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হন। ২৩ মে তাকে বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়। তারপর তাকে গোয়ালপাড়ায় ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এরপর মিডিয়াতে এ খবর প্রচার হলে মুখ খোলেন চন্দ্রমল দাস। তিনি বলেন, তিনি একজন শ্রমিক সম্পর্কে তদন্ত করে জানতে পেরেছিলেন, তার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু তিনি সানাউল্লাহ নন।

নতুন তালিকা প্রকাশের পর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে আসাম। এনআরসিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করেছেন রাজ্যটির অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু)। এই ইস্যুটি নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানায়। এ সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লুরিনজ্যোতি গগৈ জানান, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় খুশি নই। এটি অসম্পূর্ণ এনআরসি হয়েছে। তালিকা শুদ্ধ করার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হবে। আসুর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এনআরসি থেকে বাদপড়ার সংখ্যা অপ্রত্যাশিত। যা ভাবা হয়েছিল তা থেকে অনেক কম বলে দাবি আসুর। পাশাপাশি অভিযোগ, এ দেশের প্রকৃত নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, ১৯৫১ সালের পর পরিচালিত প্রথম আদমশুমারির মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ধাপে ১ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীকে নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালের জুনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ৩ কোটি ২৯ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখকে সংশোধিত নাগরিকত্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রয়টার্স নিবন্ধনসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে সেসময় জানিয়েছিল, রাজ্যের ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ মানুষ তালিকায় স্থান পায়নি। এদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী কিংবা মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ বছর জুনে তালিকায় আরেক দফা সংশোধনী আনা হয়। ২০১৮ সালে সংশোধিত তালিকায় স্থান পাওয়াদের মধ্যে থেকে ১ লাখেরও বেশি মানুষকে বহিষ্কার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবমিলে বাদপড়া ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিনটিকে ঘিরে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাদ পড়াদের মধ্যে ৩৬ লাখ মানুষ নাগরিক তালিকায় স্থান পাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আর খসড়া তালিকায় স্থান পাওয়া ২ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের মধ্যে ২ লাখের স্থান পাওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads