• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
এতিমের হকে সিন্ডিকেটের থাবা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

শিল্প

এতিমের হকে সিন্ডিকেটের থাবা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ আগস্ট ২০১৯

এবার ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া পানির দরে বিক্রি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও সতর্ক হয়ে যায়। ফলে লাখ লাখ কোরবানিদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরও অনেকে। এর পেছনে প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। আর সরকারের পক্ষ থেকেও কোরবানির পশুর চামড়ার দর নিয়ে কারসাজির কথা স্বীকার করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এবার পশু কোরবানি হয়েছে এক কোটির বেশি। কাঁচা চামড়ার ৮০ শতাংশ জোগান আসে ঈদুল আজহার সময় কোরবানির পশুর চামড়া থেকে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে অরাজকতা চলছে। এর পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা রয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের দায়ী করছেন। আর আড়তদাররা দায়ী করছেন ট্যানারি মালিকদের। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমে গেছে। দেশে সাভারের ট্যানারি শিল্পে সংকট। অন্যদিকে তাদের হাতে পর্যাপ্ত পুঁজিও নেই।

জানা যায়, একদিকে দরে ধস, অন্যদিকে চামড়া কিনতেও চাননি এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছেন অনেকে। মাটির নিচে পুঁতে ফেলার তথ্যও পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় চামড়া ফেলে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। লাখ খানেক পশুর চামড়া সড়কে ফেলে দেওয়া হয়। পরে সেগুলো সরিয়ে মাটিচাপা দেয় সিটি করপোরেশন। সুনামগঞ্জেও মাটির নিচে চামড়া পুঁতে ফেলে হেয়। দিনাজপুরে কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বাজারে ফেলে চলে যান মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

এবারো ঈদের আগে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণ করে সরকার। ট্যানারি মালিকরাও সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে। তবে ট্যানারি মালিকদের নির্ধারণ করে দেওয়া দরের অর্ধেক টাকাও মেলেনি। দেশের অনেক এলাকায় চামড়ার ক্রেতাই পাওয়া যায়নি। অবিশ্বাস্য কম দরের কারণে মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো চামড়া বিক্রি থেকে নামমাত্র অর্থ পেয়েছে। কোরবানিদাতার দরিদ্র আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা হয়েছেন বঞ্চিত। এতে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এত কম দর হওয়ার কারণ হিসেবে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা একে অপরকে দায়ী করছেন। এদিকে অবিশ্বাস্য কম দরে বেচাকেনা হওয়ায় চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তবে এবার চিত্র ভিন্ন। সরকার চামড়া রপ্তানির সুযোগ করে দিয়েছে। এবারের কোরবানিতে গত বছরের মতো গরুর কাঁচা চামড়া প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবারের মতো এবারো কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় বাজারদর বিবেচনায় রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ দাম নির্ধারণ করে দেয়। রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। খাসির কাঁচা চামড়ার দাম সারা দেশে ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির কাঁচা চামড়ার দাম হবে সারা দেশে ১৩ থেকে ১৫ টাকা। কোরবানিদাতারা বলছেন, তাদের পশুর চামড়া ১০০ টাকায়ও বিক্রি করতে হয়েছে। একই চিত্র রাজধানীর বাইরেও। দেড় থেকে ২০০, ২৫০ এবং ৩০০ টাকায় কাঁচা চামড়া তাদের বিক্রি করতে হয়েছে। অর্থাৎ নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।

রাজধানীর মোহাম্মদ মানিক খান জানান, তাদের কোরবানির পশুর চামড়া তারা ১৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রভাবশালী গত মঙ্গলবার ও গতকাল রাজধানীর চামড়ার বাজার পোস্তা ও লালবাগের চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় প্রায় পানির দরে চামড়া বেচাকেনার তথ্য। ঢাকার বাইরে থেকেও আমাদের প্রতিনিধিরা একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। ক্ষতির জন্য মাঠপর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্রেতারা দুষছেন আড়তদারদের, আর আড়তদাররা বলছেন তাদের হাত-পা বাঁধা ট্যানারি মালিকদের কাছে। বিশেষজ্ঞরাও এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে পোস্তায় চামড়া বিক্রি করতে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শান্ত ইসলাম বলেন, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সর্বনিম্ন দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তারা যে দামে চামড়া কিনেছেন, আড়তদারদের কাছে এর চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে।

লালবাগে কথা হয় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মিরপুরের বাসিন্দা মো. তালহা স্বপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ১০০টির মতো চামড়া কিনেছি। যে দামে কিনছি, তার অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পোস্তগোলার আড়তদার মো. সোলায়মান বলেন, চামড়া সংগ্রহকারীরা বাড়তি দাম চাইলে তা দেওয়া সম্ভব নয়। ট্যানারির মালিকরা কত দিয়ে চামড়া কিনবে তা আগেই জানিয়েছেন। এবার কেনা আর বেচায় পার্থক্য এত কম যে কোনো লাভ থাকছে না।

চামড়ার কম দর ব্যবসায়ীদের কারসাজি : চামড়ার দর কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। অনেকেই বলছেন, এবার চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া ফেলে দিয়েছেন। চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে।’

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মন্ত্রী জানান, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলছেন।

চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত : চামড়ার উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে বলে, নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না। এ বিষয়ে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

রপ্তানির সুযোগ চামড়া শিল্পকে হুমকিতে ফেলবে : কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিলে দেশের চামড়া শিল্প ‘হুমকির মুখে পড়বে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। সংগঠনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে চামড়া শিল্পনগরীতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী তখন কাঁচামালের অভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিস্তর জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে।

সংবাদ সম্মেলনে শাহিন বলেন, আমরা মনে করি সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। আমরা সরকার ও জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আগামী ২০ আগস্ট থেকে আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই লবণ দেওয়া চামড়া কেনা শুরু করব। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করুন।

চামড়া শিল্পের বাজারে সঠিক ব্যবস্থাপনা চালুর আহ্বান জানিয়ে ট্যানার্স অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি বলেন, ‘পশুর গা থেকে চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে ট্যানারি মালিকদের কাছে পৌঁছে দিতে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এটা না থাকায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছে।

সিন্ডিকেট করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি বলেন, চামড়ার দরপতনে সরাসরি ট্যানারি মালিকদের কিছুুই করার থাকে না।

তিনি বলেন, প্রথমে পাড়া-মহল্লায় কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে। ফড়িয়ারা বিক্রি করে আড়তদারদের কাছে। কিন্তু ফড়িয়ারা ঠিক নিয়মে চামড়া সংরক্ষণ না করে নিজেরা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। ঁকঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, রপ্তানির সুযোগের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে আমরা লাভবান হব।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে অবিলম্বে কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করবে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে অবিলম্বে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল জরুরি বৈঠক হয় এ নিয়ে। কাঁচা চামড়ার গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চামড়া সংরক্ষণের জন্য চামড়া ব্যবসায়ী ও সংরক্ষণকারীদের প্রতি আগেই অনুরোধ জানানো হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের অনুরোধ জানিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কাঁচা চামড়া নিয়ে চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনকে পূর্বনির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২০ আগস্টের আগেই জরুরি ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করার অনুরোধ জানায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।

ওবায়দুল কাদের যা বললেন : কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমার পেছনে ‘সিন্ডিকেটের কারসাজি’ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঈদের ছুটি শেষে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। চামড়া নিয়ে ‘সিন্ডিকেটের কারসাজির’ অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কাদের বলেন, চামড়ার ব্যাপারে বাস্তব চিত্রটা কী তা ভালোভাবে জানা নেই। নিরপেক্ষভাবে জানা দরকার সিন্ডিকেটের বিষয়টি। এরকম চক্র আমাদের দেশে আছে, ফয়দা লোটার জন্য সিন্ডিকেট করে। এ বিষয়টি (চামড়ার ক্ষেত্রে) হয়েছে কিনা তা খোঁজখবর নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার অভিযোগ তোলেন— ক্ষমতাসীন দলের ‘সিন্ডিকেটের কারসাজিতে’ কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে পাশের দেশে পাচার করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads