• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
“কর্মক্ষেত্রেও ঘুরে দাড়াতে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যরা”

নিজ খামার থেকে ডিম সংগৃহ করছেন নাসিমা বেগম

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

শ্রমশক্তি

পায়রা বন্দর নির্মাণের জমি অধিগ্রহন

“কর্মক্ষেত্রেও ঘুরে দাড়াতে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যরা”

  • মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
  • প্রকাশিত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

নিশ্চিত আবাসন সুবিধার নিশ্চয়তার পর কর্মক্ষেত্রেও ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা বন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যরা। বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা এখন স্বাবলম্বী হয়ে দায়িত্ব নিচ্ছে পরিবারের।

তাঁদেরই একজন গৃহবধু রিয়ামনি। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শেষে এখন চাকুরী করছেন বানাতিবাজার অগ্রনী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাকিং শাখায় মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে। অথচ পায়রা বন্দরে তার শ্বশুড় বাড়ির দুই একর(৬০ কড়া) জমি অধিগ্রহণের পর স্বামী-সন্তান নিয়ে চোখে শর্ষে ফুল দেখছিলো সে। জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্য হিসেবে স্নাতক ডিগ্রিধারী রিয়ামনি ছয় মাস ব্যাপী বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহন করে। ডরপ এর মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর এজেন্ট ব্যাকিং শাখার চাকুরী হলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। তাঁর মতো জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্য হিসেবে হারুন অর রশিদ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শেষে বানাতি বাজারে কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকান দিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি এ ব্যবসা থেকে তাঁর মাসে অন্তত ১২ হাজার টাকা। রিয়ামনি ও হারুনের মতো পায়রা বন্দরে জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যরা এখণ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে এখন স্বাবলম্বী হয়ে নতুন করে উন্নয়নের পথযাত্রায় সবার চোখে-মুখে হাসি ফুটছে।

পায়রা বন্দর নির্মানে প্রায় ৪২’শ পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব পরিবারকে জমি অধিগ্রহনের সমুদয় টাকা পরিশোধ শেষে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। দেশে এবারই প্রথম জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন সংস্থা ডরপ (ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র) ১০টি ট্রেডে এ প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।

র্ডপ’র এ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের টিম লিডার জেবা আফরোজা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তিন সপ্তাহ ও একমাসের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীগণ প্রতিদিন ৩০০টাকা ও তিন মাস ও ছয় মাসের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীগণ প্রতিদিন ৫০০টাকা করে প্রশিক্ষণ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।

তিঁনি বলেন, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় ২০১৮ থেকে জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ১১৩৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে ১০টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে চলতি বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত বেসিক কম্পিউটার, গাড়ী চালক, রাজমিস্ত্রি, পোষাক তৈরি, ওয়েলডিং, ছাগল পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, ব্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালন, মৎস্য চাষ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ, উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস মুরগী পালন ও হাঁস মুরগীর খাদ্য তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার পূর্বক পারিবারিক পরিমন্ডলে গাভী পালন ট্রেডে ২৬টি ব্যাচে মোট ৬৬৬ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। তার মধ্যে চলতি মাস (নভেম্বর) পর্যন্ত ১৫০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লালুয়া ইউনিয়নের নাসিমা বেগম উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস-মুরগী পালন ও হাঁস-মুরগীর খাদ্য তৈরী প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ৪০০ হাঁসর কিনে খামাড় গড়ে তুলেছেন। সাম্প্রতিক বুলবুলের বন্যায় তার ১৫০টি হাস মারা গেলেও নাসিমা বেগম মনোবল হারাননি। বর্তমানে প্রতিদিন ১৫০টি হাঁস ডিম দিচ্ছে। তা বিক্রি করে দৈনিক ১৫’শ টাকা আয় করছেন।

চারিপাড়া গ্রামের হাসিনা বেগম বলেন, ব্র্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালনের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বর্তমানে ৪০টি টার্কি দিয়ে খামার গড়ে তুলি। আমার এ সাফল্য দেখে এলাকার অন্যান্যরা আমার কাছ থেকে ডিম ক্রয় করে। এ পর্যন্ত আমি প্রায় ১০ হাজার টাকার ডিম বিক্রি করেছি।

কলাউপাড়া গ্রামের জাহিদা বেগম, সাহেদা বেগম, হালিমা বেগম ব্রয়লার সোনালী মোড়গের খামার গড়ে তুলেছেন। ইতোমধ্যে তারা মুরগী বিক্রি করে আয় করতে শুরু করেছেন। মঞ্জুপাড়া গ্রামের রিনি বেগম প্রশিক্ষণ ভাতা ৭ হাজার টাকাসহ ২৮ হাজার টাকা দিয়ে হাঁস কিনে খামাড় গড়ে তুলেছেন। পরবর্তীতে বড় চারশ ও ছোট চারশ হাঁস দিয়ে খামাড়ের পরিসর বড় করেন। রিনি বেগমের স্বামী জাকারিয়া হাওলাদার আগে বাহিরে কাজ করতো, এখন তিনি নিজেদের হাঁসের খামারেই শ্রম দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি ৫০ হাজার টাকার হাঁস বিক্রি করেছেন। মঞ্জুপাড়া গ্রামের আবুল কাশেম ২৪ হাজার টাকা খরচ করে পুকুরে তেলাপিয়া মাছের চাষ শুরু করেছেন। তিনি আশা করছেন মাছ বিক্রি করে তার ভালো আয় হবে। রাশিদা বেগম পায়রা বন্দর থেকে বাড়ির ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দুইটি গরু কিনেছেন। একই গ্রামের ৫শ হাঁস দিয়ে খামাড় গড়ে তুলেছেন মোসাম্মৎ হেলেনা। তিনি জানান, র্ডপ এর প্রশিক্ষণ পাবার আগে হাঁস পালনের বহু চেষ্টা করেছি কিন্তু সব সময় হাঁস মরে যেত। এখন আর কোন হাঁস মরেনি। ঋণ নিয়ে খামার বড় করার স্বপ্ন দেখছেন হেলেনা।

পায়রা বন্দর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন এম. মুনিরুজ্জামান জানান, সরকার পায়রা বন্দর নির্মানের ফলে ভূমি ও গৃহ অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে পুনর্বাসনের পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান যাতে ব্যহত না হয়, তারা যাতে উন্নত জীবন যাপন করতে পারে সে জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করতে তাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণের পর তাঁরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.মুনিবুর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসন জরুরি। পরিবারের উন্নয়নে চাহিদা মোতাবেক তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মানুষের পেশা পরিবর্তন করা কঠিন কাজ। মানুষিক পরির্বতনে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তাদের মানষিক ভাবে সাহস সঞ্চয় করানো উচিত। প্রশিক্ষণ গুলোতে এ বিষয়ে একটি সেশন থাকা উচিত।

তবে ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারের সদস্যদের দাবি, তারা প্রশিক্ষণ শেষে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন ঋণ সুবিধা। সরকার যদি তাদের ঋণ সুবিধা প্রদান করেন তাহলে তারা ভবিষতে কর্মসংস্থানেও সফল হবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads