দেশে কাজ করছেন কমপক্ষে ৫ লাখ বিদেশি। প্রতিবছর তারা ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে চার লাখ বিদেশিরই বৈধভাবে কাজের অনুমতি নেই। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দক্ষ’ বলে এ দেশে কাজ করছেন ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির নাগরিকরা। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে সর্বাধিক বিদেশি কর্মী নিয়োগ পাচ্ছে। বিদেশি নাগরিকরা সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানেই কাজ করছেন।
বিডা, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো বিদেশি নাগরিকদের দেশে কাজের অনুমতি দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিডার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কত বিদেশি নাগরিক বৈধ বা অবৈধভাবে কাজ করছেন তার সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মোট দুই লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। এর মাঝে অনুমতি নিয়ে কাজ করছেন ৯০ হাজার। বাকিরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে থেকে কাজ করছেন। আর যারা বৈধভাবে আছেন তাদের মাঝে ৫০ ভাগ কোনো অনুমতি না নিয়েই টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। এই বিদেশিরা বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ২০১৮ সালে দেওয়া ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বৈধ বিদেশির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে টিআইবি বাংলাদেশে বিদেশিদের এই হিসাব করেছে। বাস্তবে এই সংখ্যা বহুগুণ বেশি বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
বিডার প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ম না মেনে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করলেও বিডা থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে মাত্র এক লাখ বিদেশির। তাদের আয়ের ওপর সরকার যথাযথভাবে করও পাচ্ছে না। এদের মধ্যে কারো বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে বিদেশে। আবার দেশেও অনেকেই ডলারে বেতন নিচ্ছেন, কিন্তু আয়কর বিবরণীতে দেখাচ্ছেন টাকার অঙ্কে। এখানে অনেক হেরফের রয়েছে। আর যারা নিবন্ধন করেনি তারা তো কিছুই দেখায় না।
জানা গেছে, সরকারের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকেই বিডা থেকে অনুমতি নেয় না। বাংলাদেশে ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা, বিপণন, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতেই বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
এসবের মধ্যে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৈধ অনুমতি ছাড়া তারা তাদের আওতাধীন জোনে কোনো বিদেশিকে কাজ করতে দেবে না। বেজার জোনগুলোতে এক হাজারের বেশি বিদেশি শ্রমিকদের যথাযথ ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিডায় নতুন ও মেয়াদ বাড়ানোসহ নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ২৩ হাজার ৮৫৪ জন। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোয় আড়াই হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বাংলাদেশে কাজ করে এনজিও ব্যুরোর অনুমতি নিয়ে।
বিডা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ হাজার ৯১ কর্মীর শিল্প অধিশাখায় নতুন এবং মেয়াদ বাড়ানোর ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। এর বাইরেও বাণিজ্য অধিশাখায় একই সময়ে ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন ৯ হাজার ৭৬৩ জন কর্মী।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে কমবেশি ৩০ লাখ বিদেশি বসবাস করছেন। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি বিদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে কাজ করছেন। বিদেশি শ্রমিক বেশি কাজ করেন পোশাক খাতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ২০ হাজার ৭১৩ জন বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। বৈধভাবে দেশে কাজ করছেন প্রায় ৬১ হাজার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০১৫ সালের এক গবেষণায় বলছে, প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা এক বছরে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার জানায়, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা বৈধ পথে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় নিয়ে যান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব ভারতীয়দের বেশির ভাগ গার্মেন্টস খাতে কাজ করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায়, অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, ভারত, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, তানজানিয়া, আফ্রিকা, উগান্ডাসহ প্রায় ৫৫টি দেশের নাগরিক রয়েছেন।
এদিকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈধভাবে বসবাস করছেন ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯ জন বিদেশি নাগরিক। এসব বিদেশি এক হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছেন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় সংসদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন।
তৈরি পোশাক শ্রমিকদের একটি সংগঠনের নেতা আবুল হোসেন বলেন, প্রায় ১০ লাখ বিদেশি বাংলাদেশের পোশাক খাতে কাজ করছেন; যাদের অধিকাংশই অবৈধ। তাদের ওয়ার্ক পারমিটও নেই।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা সবকিছুই একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য কাজ করছি। অনেকটাই এসে গেছে। বাকিটা আসতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। এখানকার কাজ সামনে আরো সহজ হবে। সেবার গতি বেড়েছে। তখন হয়তো আরো বেশি বিদেশি এখানকার অনুমোদন নিয়েই কাজ করবেন। একসময় হয়তো দেখব বাংলাদেশে কোনো অবৈধ বিদেশি কাজ করছেন না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) সৈয়দা জান্নাত আরা বলেন, বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি ভিসায় আসা আফ্রিকানদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপরাধ চক্রে জড়িত এমন চক্রে প্রতারণার শিকারদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও এত বছর তারা কী করেন বাংলাদেশে অবস্থান করছিল তা খতিয়ে দেখা হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, বিদেশিরা এ দেশে বৈধভাবে আসলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই মূলত তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে তাদের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমের সচেতনতার পাশাপাশি যেসব বাড়ি মালিক বা দেশীয় নাগরিক তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বিদেশিদের বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় বৈধ কাগজপত্র যাচাই করা গেলে অবৈধভাবে এ দেশে অবস্থান রোধ করা সম্ভব হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিদ্যমান আইনের বিধানে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সেটি সংশোধন করা উচিত। বিনা অনুমতিতে বিদেশি কর্মী কাজ করলে সে কর্মী ও তার নিয়োগদাতা দুজনকেই আইনের আওতায় আনা হবে, এমন একটি কার্যকর বার্তা দেওয়া যায় কি না, তা ভাবা উচিত। একটি সময়ের পর সেই বার্তাটি অর্থবহ করতে অ্যাকশনে যাওয়া উচিত। ভিজিট ভিসায় আসা লোকদের ভিসা নবায়নে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। না হলে আমাদের বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কর্মী ও তাদের পাঠানো আয় নিজ দেশে পাঠানোর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। আমাদের প্রবাসী কর্মীদের হাড়ভাঙা খাটুনির টাকার একটি বড় অংশ নেবে তারাই। লাভের গুড় খাবে পিঁপড়ায়।
৮ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ভিসা ও পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও যেসব বিদেশি এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করছেন প্রয়োজনে সরকারি খরচে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।