• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মামলার আসামিরা প্রকাশ্যেই ঘুরছেন

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

সংরক্ষিত ছবি

আইন-আদালত

কয়লা আত্মসাৎ : গ্রেফতারে দুদকের অনীহা

মামলার আসামিরা প্রকাশ্যেই ঘুরছেন

নিষেধাজ্ঞার মাঝেই দেশত্যাগের চেষ্টা

  • সাঈদ আহমেদ
  • প্রকাশিত ২৯ আগস্ট ২০১৮

প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ আসামি। তাদের আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা, তলবি নোটিশের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে এনে সসম্মানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর ফলে আলোচিত এ মামলার তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ১৯ আসামির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ তাদের কয়েকজন দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছেন। অনেকেই নিজেকে ‘নির্দোষ’ প্রমাণে ওপর মহলে সাধ্যমতো চালিয়ে যাচ্ছেন দৌড়ঝাঁপ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আসামিদের আইনের আওতার বাইরে রেখে তদন্ত চালালে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। ছোটখাটো অনেক মামলায় তৎক্ষণাৎ আসামি গ্রেফতারের অসংখ্য নজির স্থাপনের পর বড়পুকুরিয়া কয়লা দুর্নীতির মতো আলোচিত মামলার আসামিদের গ্রেফতারে অনীহা দেখালে তদন্তের নিরপেক্ষতা এবং গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের দুটি জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বলেছিলেন, দুদকের মামলার আসামিদের ঠিকানা কারাগার। কারাগারের বাইরে থাকতে হলে আসামিকে অবশ্যই জামিন নিতে হবে। তার এ বক্তব্যের পরবর্তী ৭ মাসে ৩৫০ এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে যান দুর্নীতি মামলার অনেক আসামি, অনেকে গোপনে পাড়ি জমান বিদেশে। গ্রেফতার আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের মতো ব্যক্তিও মামলার আগেই আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে ‘লাইন দেন’। এখনো দুদকের শীর্ষ পদে রয়েছেন ইকবাল মাহমুদই। তবে ‘বদলে গেছে’ দুদকের অবস্থান ও নীতি, যার ‘একচেটিয়া মওকা লুটছেন’ দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের কয়লা আত্মসাৎ মামলার সব আসামি। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার একজন আসামিকেও এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। এই সুযোগে প্রভাবশালী আসামিরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে দুদক ও সরকারের উচ্চমহলে জোর তদবির করছেন।

দুদক সূত্র আরো জানায়, গত ২৪ জুলাই বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবউদ্দিনসহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলাটি হয়। মামলাটি তফসিলভুক্ত হওয়ায় দুদক তদন্ত করছে। কমিশনের উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম পরিচালনা করছে তদন্ত কার্যক্রম। এ প্রক্রিয়ায় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দফায় ১২ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার আরো ১৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ আসামিসহ ২১ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পেট্রোবাংলার মাধ্যমে পৃথক তলবি নোটিশ দেওয়া হয়। এজাহারভুক্ত আসামিদের কেন আজো গ্রেফতার করা হয়নি- জানতে চাইলে গত ২৭ আগস্ট সোমবার দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধের কৌশলের মতোই কখনো কখনো কৌশলগত কারণেই দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার বা অন্যান্য আইনের প্রয়োগ একটু শিথিল করা হয়। আবার উপযুক্ত সময়ে তা তীব্র করা হয়।

এজাহারভুক্ত আসামি গ্রেফতার প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যানের পূর্বের ও বর্তমান অবস্থানকে বৈষম্যমূলক এবং ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ বলে মন্তব্য করেছেন  আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, সংবিধান, আইন ও সরকারি কোনো বিধিবিধান সবার জন্য সমান। ব্যক্তি পরিচয়, পেশা কিংবা দলীয় পরিচয় কখনো বিবেচ্য হওয়া কাম্য নয়। কোনো আসামিকে মামলা রুজুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে আবার কোনো আসামিকে নোটিশের মাধ্যমে অফিসিয়ালি ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে- এমন দ্বৈত নীতি দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানে থাকতে পারে না। দুদক কয়লা কেলেঙ্কারি মামলার আসামিদের গ্রেফতারের মাধ্যমে আইনের আওতায় এনেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারত। কাউকে গ্রেফতার করবেন, কাউকে ডেকে এনে সম্মান দেখাবেন- এমন নীতিতে জনমনে কমিশন সম্পর্কে ভিন্ন বার্তা যাবে।

একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশের খবরকে টেলিফোনে বলেন, আসামিকে গ্রেফতার করা কিংবা না করা- দুটোই মামলার তদন্ত কৌশল হতে পারে। কী ধরনের ভাবনা থেকে দুদক এটি করছে, তা দুদকই বলতে পারবে। তবে বাইরে থেকে এটুকুন ধারণা করা যেতে পারে, কয়লা দুর্নীতি মামলার আসামিরা এখন অবধি আইনের আওতার বাইরে থেকে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। কারণ দুদকের অন্য মামলার আসামিদের যেমন রাত-দিন অভিযান চালিয়ে পাকড়াও করা হয়, তেমনি কয়লাখনির আসামিদের বেলায় ঘটেনি। জনমনে এই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, এ মামলার আসামিরা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা। তাই হয়তো দুদক তাদের এখনই আইনের আওতায় আনতে চাইছে না।

বড়পুকুরিয়ার ১ লাখ ৪৫ হাজার টন কয়লা খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে ২৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় খনি সংশ্লিষ্টরা। এতে কয়লা সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যায় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। এ ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন; আসামি করা হয় ১৯ জনকে।

গতকাল মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে দুদকের সচিব ড. শামসুল আরেফিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, মামলাটির বাদী দুদক নয়। কিন্তু যেহেতু এটি তফসিলভুক্ত অপরাধ তাই দুদক তদন্ত করছে। দুদক বাদী হয়ে মামলা করলে সেটির একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান হয়। এ মামলার ক্ষেত্রে দুদক সেটি করতে পারেনি। তাই তদন্ত প্রক্রিয়ায় সতর্কতা ও কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। ‘আসামিদের আইনের আওতায় আনতে দুদকের অনীহা কেন’- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুদক কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করছেন। গ্রেফতার করা না করা তাদের এখতিয়ার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads