• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বিচার শেষ হয়নি ১৪ বছরেও

ছবি : সংগৃহীত

আইন-আদালত

বিচার শেষ হয়নি ১৪ বছরেও

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ১৭ আগস্ট ২০১৯

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি ১৪ বছরেও। বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় জঙ্গিরা জামিন নিয়ে ছাড়া পেয়ে ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। বেশ কয়েকজন একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছে। তবে গোয়েন্দা পুলিশ দাবি করছে, জঙ্গিদের কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। জামিনে ছাড়া পাওয়া জঙ্গিদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সে কারণে বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তারা গোয়েন্দা জালে ধরা পড়ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, সিরিজ বোমা হামলার সব মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে পুলিশ যথাসময়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। বেশিরভাগ মামলাই ইতোমধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। অবশিষ্ট কিছু মামলা এখনো বিচারাধীন।

তিনি আরো বলেন, জামিনে বা সাজা ভোগ শেষে মুক্ত জঙ্গিদের ওপর নজর রাখছে পুলিশ। দেশের আটটি বিভাগের প্রত্যেকটির জন্য আলাদা করে ডাটাবেজ তৈরির কাজ শেষদিকে। এই ডাটাবেজকে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত এবং মামলার আসামি জঙ্গিদের সার্বিক তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ফলে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদের ওপর নজরদারি আরো সহজ হবে। এ ছাড়াও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের মোটিভেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও সংগঠন এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রায় ৪৪৩টি স্পটে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এতে দুজন নিহত এবং আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। একমাত্র মুন্সীগঞ্জ জেলায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটেনি।

রোমহর্ষক ওই হামলার ঘটনায় ১৫৯টি মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয় ১৩০ জনকে। তদন্ত শেষে এক হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় ৯৬১ জনকে। সাজাপ্রাপ্ত ৩৩২ জনের মধ্যে ২৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হলেও বাকি ২১ জন এখনো পলাতক। এসব মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে ৩৫৮ জনকে। বর্তমানে জামিনে আছে ১৩৩ আসামি। বাকিরা পলাতক।

সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সর্বোচ্চ ২৩টি মামলা হয় ঢাকা ও খুলনা রেঞ্জে। সর্বনিম্ন ৩টি করে মামলা হয় খুলনা মহানগর ও রেলওয়ে রেঞ্জে। মহানগরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ঢাকায়। এখানে ১৮টি মামলা হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয় ৯টি মামলায়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে ৯টির। এই ১৩ বছরে আসামিদের মধ্যে সাজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তবে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ৬ জনের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন— শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি।

এই সিরিজ বোমা হামলার পর জঙ্গিরা যে আল্টিমেটাম দিয়েছিল তার ভিত্তিতেই তারা একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলা পরিচালনা করতে থাকে। বিচারক, উকিল ও পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এই তিন শ্রেণির ওপরই বেশি হামলা করে এবং বেশ কিছু ব্যক্তিকে হতাহত করে তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান জানান, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব মামলার মধ্যে অভিযোগপত্র  দেওয়া হয়েছে ১৪২টির। অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ১৭টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির সংখ্যা এক হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৭৬১ জন। বর্তমানে জামিনে আছে ১৩৩ আসামি। যেসব মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলোতে ৩২২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। খালাস দেওয়া হয়েছে ৩৫৮ জনকে। আসামিদের মধ্যে ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) এক কর্মকর্তা বলেন, যাদের ফাঁসি এখনো কার্যকর করা যায়নি, তারা পলাতক। যারা সাজা খেটে বেরিয়ে গেছে বা জামিন নিয়ে পলাতক তারা ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। তবে তারা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। অনেকে ধরা পড়ছে। এই মুহূর্তে বড় ধরনের হামলা চলানোর শক্তি তাদের নেই। জঙ্গিরা যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে সে জন্য পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গিরা বেশিরভাগ স্থানেই রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। কোথাও টিফিন ক্যারিয়ারে বোমা রাখা ছিল। এসব বোমা জঙ্গিদের হাতে তৈরি। হামলার স্থান হিসেবে ওরা সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধা-সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে বেছে নেয়। হামলাস্থলে জেএমবির লিফলেট ছিল। সেখানে ‘আল্লাহর আইন কায়েম ও প্রচলিত বিচার পদ্ধতি’ বাতিলের দাবি ছিল। ওই হামলার পর থেমে থাকেনি জঙ্গি কার্যক্রম। ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি ছিনতাই, বিভিন্ন স্থানে ব্যাংক লুটের ঘটনায় জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ওই সিরিজ বোমা হামলার পথ ধরেই।

ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জামিনে ছাড়া পাওয়া জঙ্গিদের খোঁজখবর ডিবির কাছে নেই। তাদের মনিটরিং করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

পুুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের কাছে কোনো জঙ্গি একবার ধরা পড়লে তারা কারাগারে বা বাইরে থাকলেও পুলিশের নজরদারিতে থাকে। সিরিজ বোমা হামলায় যেসব জঙ্গি জামিনে ছাড়া পেয়েছে, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তারা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার কোনো খবর নেই।

ডিসি সানোয়ার আরো বলেন, যারা সঠিক পথে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় কাউন্টার টেররিজমের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু জঙ্গি বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে।

এদিকে, ঢাকায় সরকারপক্ষের আইনজীবী শাহ আলম তালুকদার জানান, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মোট ১৮টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুটি মামলার রায় হয়েছে। ১১টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে এবং বাকি ৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে। রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দায়ের করা একটি মামলায় ঢাকার একটি আদালত একজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও আরেকজনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া বিমানবন্দর থানার অন্য আরেকটি মামলার রায়ে ৫ জনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

তিনি আরো বলেন, ঢাকার বিচারাধীন ৫টি মামলা সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। বিচারাধীন এই মামলাগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া শিগগিরই শেষ করা যাবে বলে আশা করছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads