• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
আসছে নির্মল বায়ু আইন

ছবি : সংগৃহীত

আইন-আদালত

আসছে নির্মল বায়ু আইন

দূষণের শাস্তি ২ বছর জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘নির্মল বায়ু আইন-২০১৯’ পাস হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এতে বায়ুদূষণের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা কমপক্ষে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি পেতে হবে।

আইনের খসড়া অনুযায়ী, বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরই হবে আইন প্রয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা। অধিদপ্তর দূষণ নিয়ন্ত্রণে বায়ুর মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে। সরকার বায়ুদূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রকল্প ও কাজের তালিকা প্রকাশ করতে পারবে। এছাড়া বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কেউ বিশেষ অবদান রাখলে তাকে সরকার পুরস্কৃত করবে।

খসড়া আইন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুমানের উন্নতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক যা প্রয়োজনীয় মনে করবেন সেসব কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবেন।

বায়ুদূষণ রোধে মহাপরিচালক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বায়ুমান পরিবীক্ষণ যন্ত্রপাতি বা পদ্ধতি স্থাপন, ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও উপাত্ত সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দিতে পারবেন। কোনো উপায়ে বায়ু দূষিত করলে বা করতে পারে- এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হলে দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও উপশমের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিকে আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবেন।

বায়ুদূষণ ঘটাতে পারে এমন সব উৎপাদন প্রক্রিয়া, দ্রব্য ও বস্তু নিয়ন্ত্রণ বা পরিহার করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিতে পারবেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

বায়ুদূষণের মাধ্যমে কোনো ক্ষতি হলে মহাপরিচালক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে তা পরিশোধ এবং যথাযথ ক্ষেত্রে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিতে পারবেন।

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ না দিলে মহাপরিচালক আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা বা নির্দেশ পালনে ব্যর্থতার জন্য ফৌজদারি মামলা বা উভয় মামলা দায়েরে করতে পারবেন। লিখিত নোটিশ দেওয়ার পর মহাপরিচালক বায়ুদূষণকারী যে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারবেন।

মহাপরিচালকের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি কোনো নোটিশ না দিয়ে দূষণের উৎসস্থলে প্রবেশ করে তল্লাশি করতে পারবেন। এমনকি কোনো সরঞ্জাম, শিল্প-প্ল্যান্ট, রেকর্ড, নথি, রেজিস্ট্রার, দলিল বা এ সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরীক্ষা এবং যাচাই ও জব্দ করতে পারবেন।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার সময়ে সময়ে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন বা বিধিমালার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকা, বায়ুর মানমাত্রা, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, নির্দেশিকা ও নির্ণায়ক বা মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারবেন। এটা সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মানতে হবে।

সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন, পরিবহন ও অন্যান্য উৎসের (বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটভাটা, সিমেন্ট কারখানা, ইস্পাত কারখানা, লৌহ ঢালাই, বয়লার ইত্যাদি) বায়ু নিঃসরণ মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে। প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, গৃহাভ্যন্তরীণ ও পরিবেষ্টিত বায়ুর মানমাত্রা নির্ধারণও করে দেওয়া হবে।

নির্ধারিত মানমাত্রা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে পরিবেশ অধিদপ্তর এ আইন কার্যকর হওয়ার পর সময়ভিত্তিক একটি জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। এ পরিকল্পনা পাঁচ বছর অন্তর পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

সরকার গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোনো এলাকাকে ডিগ্রেডেড এয়ারশেড বা বিশেষ নিয়ন্ত্রণ এলাকা ঘোষণা করতে পারবে।

সরকারি বিরল প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক আবেদনসম্পন্ন বা বিশেষ বায়ুমান ব্যবস্থাপনা গ্রহণের দাবি রাখে এমন এলাকায় শিল্প বা প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ বা বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে।

বায়ুদূষণকারী বিদ্যমান শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে সরকার। প্রয়োজনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ওই এলাকা থেকে স্থানান্তরের নির্দেশ দিতে পারবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া সরকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিবেশগত বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বা হতে পারে এমন বায়ুদূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রকল্প ও কাজের তালিকা প্রকাশ করতে পারবে।

সরকার বায়ুদূষণকারী কোনো দ্রব্য বা বস্তুকে সার্বিকভাবে বা কোনো নির্দিষ্ট এয়ারশেডের জন্য প্রধান বায়ুদূষক হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশব্যাপী উপযুক্ত স্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রসহ আন্তঃদেশীয় বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বায়ুমানের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা মূল্যায়নের জন্য বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রগুলোর তথ্য সংরক্ষণ করবে।

যানবাহন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রকারী ব্যক্তিরা বায়ুর নির্ধারিত মানমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থা পরিকল্পনায় সুপারিশকৃত কর্মপদ্ধতি মেনে চলবে। পরিবেশ অধিদপ্তর সময়ে সময়ে যানবাহনের নিঃসরণ পরীক্ষা করবে এবং বেশি দূষণকারী পুরাতন যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে।

বায়ুর নির্ধারিত মানমাত্রা ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিশ্চিতে পরিবেশ অধিদপ্তর যানবাহনে ব্যবহূত ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করতে পারবে। লাইসেন্স দেওয়ার জন্য বিআরটিএ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যানবাহনের নিঃসরণ মাত্রা সরকারের মাত্রা অনুযায়ী নিশ্চিত করবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণ কাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সরকার নির্ধারিত বায়ুর মানমাত্রা অনুসরণ করবে।

বায়ুমান উন্নয়ন তহবিল নামে একটি আলাদা তহবিল গঠন করা হবে, যা বিধিমালার মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুর গুণগত মান রক্ষা ও উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখলে তাকে সরকার উৎসাহিত ও পুরস্কৃত করবে।

আইন অনুযায়ী কেউ যদি কোনো প্রতিবেদন দাখিল বা তথ্য দিতে ব্যর্থ হন বা মিথ্যা বিবৃতি দেন বা মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে কেউ লাইসেন্স বা অনুমোদন নিলে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।

সরকার নির্ধারিত বায়ুর মানমাত্রা না মানা ও বায়ুদূষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খসড়া আইনে উল্লিখিত বিধি-বিধান না মানলে কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হবেন। প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা হবে। একই অপরাধ আবারো করলে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা কমপক্ষে দুই বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়া নির্মল বায়ু আইনে বলা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত এ আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারবেন। পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আইনটিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ক্ষমতায়ন, অর্থ ও জনবল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আইনটি সংবিধানের ১৮(খ) অনুচ্ছেদকে সামনে রেখে করা হয়েছে, যাতে অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। কোনো অবস্থায় পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের বিভিন্ন অংশে বায়ুমান সন্তোষজনক অবস্থায় রাখা এবং পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিকের জীবন ও বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য একটি আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিশুদ্ধ ও লাগসই প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থা উৎসাহিত করার মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধ ও প্রশমনে নির্মল বায়ু আইন করা হচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্পের পরিচালক ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, বায়ুদূষণ এই দেশের জন্য খুব জটিল একটি সমস্যা। আমরা সব সেক্টরে যেমন, যানবাহন, নির্মাণকাজের মতো ক্ষেত্রেও বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নির্মল বায়ু আইনের খসড়া করেছে পরিবেশ অধিদফতর। এখন খসড়ার বিষয়ে আরো মতামত নেওয়া হবে। মতামত নেওয়ার পর আমরা সবার সঙ্গে বসব খসড়াটি চূড়ান্ত করার জন্য।’ সচিব আরো বলেন, ‘আমরা এ বছরের মধ্যেই আমাদের পর্যায়ে চূড়ান্ত করে আইনটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর চেষ্টা করছি।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, ঢাকার বাতাস এখন সিসাসহ মারাত্মক ক্ষতিকর দূষণের শিকার হচ্ছে। পরিবেশদূষণ বাড়ছে। বর্তমান সরকার পরিবেশদূষণে কঠোর আইন করছে। আশা করছি সারা দেশ পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে। এসডিজি উন্নয়নে টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯ (এসওজিএ)’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণে। প্রথম চারটি দেশের মধ্যে আছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। এর পরেই আছে বাংলাদেশ অর্থাৎ বিশ্বে বায়ুদূষণে মৃত্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

এতে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মাত্রা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নেপালে সবচেয়ে দূষিত বায়ু ছিল। এরপর রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এ অঞ্চলে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর বায়ু ভুটানের। ডব্লিউএইচও’র নিচের মাত্রাটির খুব কাছে তাদের অবস্থান। অঞ্চল ভিত্তিতে মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণে দক্ষিণ এশিয়ার পরে আছে সাব সাহারা আফ্রিকা।

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads