• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

আইন-আদালত

আবরার হত্য‍া

মামলার অভিযোগপত্র চলতি সপ্তাহেই : ডিবি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ নভেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।

আবদুল বাতেন বলেন, বুয়েটে আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় আমরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা বলেছিলাম। আমরা এ লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের তদন্ত কাজ প্রায় সম্পন্ন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

হত্যাকাণ্ডের মোটিভের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটিভ যাই থাকুক, কাউকে হত্যা করার অধিকার কারো নেই। আমরা এখন পর্যন্ত যা পেয়েছি, শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে মারধর করা হয়েছিল।

জড়িতদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ আসামির মধ্যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এজাহারবহির্ভূত গ্রেপ্তার ৫ জন। এই ২১ জনের মধ্যে ৭ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া ইতোমধ্যে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডস্থল বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ক্যান্টিন-বয়, শিক্ষক, গার্ডসহ কয়েকজন ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার বস্তুগত সাক্ষ্য ওবং প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। মামলার তদন্তে যে সমস্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন করা দরকার, তা সম্পন্ন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ২১ জনের বিরুদ্ধেই প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাদের নাম উল্লেখ করেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আবরারকে সরাসরি মারধর করেছিলেন ছাত্রলীগের অন্তত ১০ নেতাকর্মী। তাদের তিনজন ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে তাকে বেধড়ক পেটান। দুজন ব্যবহার করেন প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ)। পাঁচজন কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় মারেন। এভাবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আবরার। এই হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা পুলিশ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ২৮ জন জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তবে তাদের সবাই মারধরে অংশ নেননি। অধিকাংশ ব্যক্তিই যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতার নির্দেশে। কেউ কেউ আবরারকে পানি খাওয়াতে ও শুশ্রূষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকারের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আবরারকে বেশি মারধর করেন অনিক।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ২৮ জনের বাইরে ঘটনার সঙ্গে মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, সহসভাপতি তাহসিন ইসলাম, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ, সাহিত্য সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান এবং উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ যুক্ত ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে শিবিরের নেতাকর্মীদের নাম বের করার নির্দেশ দেন মেহেদী হাসান। আর ঘটনা নিয়ে ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপে আলোচনায় অংশ নেন অমিত সাহা। আবরার কক্ষে আছেন কি না, সে তথ্য নিশ্চিত করেন মনিরুজ্জামান। ঘটনা চলার সময়ে আবরারের পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে অবহিত ছিলেন মুজতবা রাফিদ, তাহসিন ইসলাম ও ইশতিয়াক আহমেদ।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপ-সম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল বলেছেন, রাত আটটার কিছু পর আবরারকে নিয়ে মুনতাসির আল জেমি, আলিম, তোহা, মাজেদ, রাফাত, শামিম, মোরশেদ, রাফিদ ইমাম, মোয়াজ, গালিব, সাইফুল ২০১১ নম্বর কক্ষে আসেন। তবে নাজমুস সাদাত তার জবানবন্দিতে তানিম, সাখাওয়াত, অভি, আবু নওশাদ সাকিব, শাহিন, হাফিজুর রহমানসহ আরো কয়েকজনের নাম বলেন।

নাজমুস সাদাত আরো বলেছেন, ২০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে তারা ইফতি মোশাররফ সকাল, মুজাহিদুর রহমান, মনিরুজ্জামান, তানভীর, মুজতবা রাফিদ ও আকাশ হোসেনকে দেখেছেন। আর ইফতি মোশাররফ বলেছেন, আবরারকে নিয়ে আসার আগেই কক্ষে মুজতবা রাফিদ ও বিটু ছিলেন। কিছুক্ষণ পর যান তানভীর ও মুজাহিদ। আবরারের একটি মুঠোফোনে কিছু সময় তল্লাশি চালিয়ে মুজতবা রাফিদ দিনাজপুর চলে যান। পরে সেই ফোনে তল্লাশি করেন তানভীর।

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকালের ভাষ্যমতে, আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রথম চড় মারেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন। এরপর ইফতি ক্রিকেটের স্টাম্প আনতে বলেন। শামসুল আরেফিন রাফাত একটি স্টাম্প তার হাতে দেন। ইফতি আবরারকে চার-পাঁচটি বাড়ি দিলে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। এরপর মুনতাসির আলম ওরফে জেমি আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আসেন। আবরারকে তখন ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার বুয়েটে শিবিরের কে কে আছে জিজ্ঞাসা করছিলেন আর চড় মারছিলেন। অনিক তখন স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু এবং বাহুতে মারতে থাকেন। আবরার হঠাৎ উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করলে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন তাকে চড় মারেন এবং হাঁটুতে স্টাম্প দিয়ে বাড়ি দেন। রবিন, অনিক ও জিয়ন একসময় কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান ওই কক্ষে আসেন।

ইফতি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ছাত্রলীগের সদস্য মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। তখন ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে মারেন। এ সময় খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম চড়-থাপ্পড় মারেন। রাত ১১টার দিকে অনিক আবার এলোপাতাড়িভাবে আবরারের শরীরে শতাধিক আঘাত করেন।

নাজমুস সাদাত বলেছেন, তিনিসহ জেমি ও এহতেশামুল রাব্বী আবরারকে চড় মারেন। শামীম বিল্লাহ স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। আবরার অসুস্থ হয়ে পড়লে মনির তখন মোর্শেদকে ফ্যান আনতে বলেন। মোর্শেদ ফ্যান নিয়ে এলে অনিক ফ্যান দিতে নিষেধ করেন। আবরারকে পানি খাওয়াতে চাইলে ইফতি বাধা দেন। আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললে অনিক, ইফতি ও রবিন বলেন, ‘ওর কিছুই হয়নি।’

ইফতি মোশাররফ জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন রবিন। তখন নিচে নেমে হলের মেইন গেটে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন রাসেল। এ সময় জেমি দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের ডাক্তার নিয়ে আসেন। ডাক্তার সিঁড়ির লেন্ডিংয়ে আবরারকে দেখে বলেন, ও মারা গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads