• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভাষা ও সংস্কৃতি

প্রতীকী ছবি

সাহিত্য

ভাষা ও সংস্কৃতি

  • প্রকাশিত ২৩ জুন ২০১৮

বস্তুর প্রাণ আছে কি-না, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সন্দেহের শেষ নেই। বিজ্ঞানী নিউটন মনে করতেন বস্তু নিশ্চল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন বস্তু মোটেই নিশ্চল নয়; বরং সদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বস্তুর ভাষা আছে কি-না আমরা জানি না। তবে প্রাণিজগতের মধ্যে শিম্পাজী, বানর, মৌমাছি, পাখি, তিমি, ডলফিন, কুকুরসহ গৃহপালিত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার আদান-প্রদান লক্ষ করা যায়। প্রাণিজগতের মধ্যে লেখ্য ও কথ্য ভাষা কেবল মানুষেরই আছে। 

ভাষা সম্পর্কে ভারতীয় সাহিত্যিক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ভাষা মানুষের প্রজাতিক বৈশিষ্ট্য; বিবর্তনের ফলে তার দেহের বিশেষ গঠন (মস্তিষ্ক, কণ্ঠ, ওষ্ঠ, জিহ্বা) ইত্যাদি তাকে এই সামর্থ্যের অধিকারী করেছে। অন্যান্য প্রাণী তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন যতটুকু করতে পেয়েছে, তার চেয়ে মানুষ কয়েক কোটি গুণ বেশি করতে সক্ষম হয়েছে। মনের ভাব প্রকাশের জন্য তারা প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, যা তাকে নতুনভাবে চিনতে ও শিখতে সাহায্য করেছে। মানব সমাজের আদিম যুগের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, মানুষ যখন ভয়ভীতি এবং অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করত তখন তারা ইশারার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করত।

অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় জবানশক্তি থাকায় তারা কণ্ঠ দ্বারা প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হতো। কালক্রমে এই শব্দকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য তারা চিহ্ন বা বর্ণ আবিষ্কার করতে শেখে। এই বর্ণ বা চিহ্ন তারা প্রস্তর, বৃক্ষ, বৃক্ষের পাতা, মাটির ফলক, চামড়া প্রভৃতির ওপর লিখে রাখার ব্যবস্থা করে। তাই তো আমরা প্রাচীন শিলালিপিতে হাজারো সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ধর্মীয় সংলাপ, নীতিবাক্য প্রভৃতি লক্ষ করে থাকি।

জীবন-জীবিকার অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানবসমাজ বিভিন্ন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন সভ্যতা কোনো জাতিকে চিনতে সাহায্য করে। যেমন— ফনিশীয়, আরবীয়, ভারতীয়, আমেরিকান, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান প্রভৃতি। আমরা দৈশিক বিভক্তির সঙ্গে কালিক বিভক্তির বিষয়টিও অস্বীকার করতে পারি না। তাই মানুষকে আদিম মানুষ, পাথরের যুগের মানুষ, মধ্যযুগের মানুষ, আধুনিক মানুষ হিসেবে শনাক্ত করি। অধুনা ফ্যাশন ও উত্তরাধুনিকতা শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে। তবে দৈশিক ও কালিক বিভক্তির পাশাপাশি ভাষাগত বিষয়টি মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্রে একই সময় এসে হাজির হয়েছে। তাই আমরা বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষের এবং সেই ভাষা অনুসারে পরিচিতি লক্ষ করি। কিন্তু একটি শিশু কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করবে এবং কোন ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হবে, তা আমাদের মানবীয়জ্ঞানের অতীত। এক্ষেত্রে হিউম্যান জেমস প্রকল্প জেনেটিক সায়েন্সে বিপ্লব এনেছে। মানুষের জীবন সম্পর্কে তারা বলেছে, তিনশ কোটি ডিএনএ বেইজ পেয়ারসের মাধ্যমে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কর্মকাণ্ড অর্থাৎ রোগ, শোক, সামাজিক গঠন, চিন্তাশক্তি এমনকি জন্ম-মৃত্যু পর্যন্ত সংকেত আকারে লিপিবদ্ধ থাকে। এ ধরনের তথ্য আবিষ্কার মানবজাতিকে হতবাক করে দেয়। এ সংকেত যদি কোনো কালে মানুষ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়, তাহলে তার ভাগ্যও সার্বিকভাবে পরিবর্তিত হবে। তবে মানুষের জন্ম যে সমাজেই হোক না কেন, সে সমাজের ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে পরাধীন করে ফেলে। আর পরাধীনতার ভেতর সে স্বাধীন। সে প্রাথমিকভাবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সবচেয়ে কাছের মানুষ মায়ের ভাষা শিখতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সমাজে এর প্রভাব পড়ে। মা কথাটি যেমন মধুর, তেমনি মায়ের ভাষাটিও মধুর। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অকৃত্রিম অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য মায়ের ভাষার বিকল্প নেই। এই মায়ের ভাষার মূল্য এত বেশি যে, কোনো কোনো জাতির পরিচয় এই ভাষা অনুসারে আমরা দেখে থাকি। গ্রিক, রুশ, ইংরেজ, চাইনিজ, থাই, মালয়, আরবি প্রভৃতি ভাষা অনুসারে সে জাতির পরিচয় আমরা লক্ষ করি। আর আমরা যে বাঙালি এবং আমাদের মায়ের ভাষা যে বাংলা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে কোনো দেশের জাতীয়তার ভেতরে একাধিক আঞ্চলিক ও উপজাতীয় ভাষা থাকে। তারা যে পরিমণ্ডলেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তাদের অবশ্যই একটি মায়ের ভাষা থাকে। তাই উপজাতিদের ভাষা সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন করতে দেখা যায়। এটি তাদের মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল উদাহরণ। মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। মাতৃভাষার জন্য তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে জগদ্বাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত দু-একটি ভাষা টিকে থাকবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু যতই হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হোক না কেন, বিশ্ববাসী মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যাবে। এই ভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও উচ্চতা যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন ষোড়শ শতকের কবি সৈয়দ সুলতান। কবি বলেন, ‘যারে সে ভাষে প্রভু করিলো সৃজন/সেই তার মাতৃভাষা,/অমূল্য সে ধন।’ আবার কবি রামনিধি গুপ্ত স্বদেশী ভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি কবিতার ভাষায় বলেন— ‘নানান দেশের নানান ভাষা/বিনে স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা/নানা জলাশয়ের নানা নীরবিনে ধারার জল মিটে কি চাতকীর।’

ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাণ আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসী থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার কল্পনা সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হূদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ, মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনো জাতি কখনও কি বড় হইতে পারিয়াছে? আরব পারস্য জয় করিয়াছিল, পারস্য আরবের ধর্মের নিকট মাথা নিচু করিয়াছিল; কিন্তু আরবের ভাষা লয় নাই। শুধু লইয়াছিল তাহার ধর্মভাব আর কতকগুলি শব্দ। তাই ফেরদৌসী, সাদী, হাফিজ, রুমী প্রমুখ কবি ও সাধক বুলবুল কুলের কলতানে আজ ইরানের কুঞ্জকানন মুখরিত।’

মাতৃভাষার সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির একটা গভীর সম্পর্ক আছে বলে আমরা জেনেছি। একটা কথা আছে— বাঁচার জন্য আনন্দের উপকরণ চাই। আর সাহিত্য-সংস্কৃতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত সাহিত্যগুলো অধিকাংশই তাদের নিজেদের ভাষায় রচিত। সুতরাং স্বদেশী সাহিত্যে সংস্কৃতির চর্চা এবং জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য মাতৃভাষার বিকাশ প্রয়োজন।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী এখানে রাজত্ব করেছে বিভিন্ন সম্প্রদায়। রাজা শশাঙ্কের পর থেকে পাল আমল, সেন আমল, মোগল আমল, ইংরেজ ও পাকিস্তান আমল— সব যুগেই আমাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে নিজস্ব ধারায়। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা দেওয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা বিভাগ চালু নেই অথবা নতুন এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ লক্ষণীয়, যা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার পক্ষে উদ্বেগজনক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু থাকুক এবং বাঙালি জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এগিয়ে যাক, এই আশা করি।

শহিদুল ইসলাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads