• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন খাঁটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার জ্ঞান তাপস

সংরক্ষিত ছবি

সাহিত্য

বাংলা সাহিত্য ও হুমায়ুন আজাদের ভাবনা

  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০১৮

হাসান হাবিব

প্রথাগত চিন্তাকে অতিক্রম করে যিনি বাংলা সাহিত্যে চিন্তার আভিজাত্যে নতুনত্ব আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি হলেন হুমায়ুন আজাদ। আমরা যদি পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সমাজের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখি, যে সমাজের চিন্তা ও মগজে সুউচ্চ ক্যাথলিক চার্জগুলো হাজার বছর দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে বার্ট্রান্ড রাসেলের (১৮৭২-১৯৭০) চিন্তা এসে দাঁড়াল অন্ধকার আলোকে (Darkfocus); কিন্তু তারই আগে পার্সি বিশি শেলীর (১৭৯২-১৮২২) চিন্তা শুনিয়েছিল অন্ধকার আলো হচ্ছে প্রথাগত চিন্তা। আর কিনা সে ক্যাথলিক রাজত্বে তার ‘power like a desolating pestilence pollutes whatever it touches’ শব্দগুলো যে কতটা বিস্ফোরক ও বীরত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা হয়তো ইংল্যান্ডবাসীও জানত না! তবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যে কত যন্ত্রণা তাও বুঝে নেওয়ার জন্য কি প্রস্তুত ছিল শেলী? অবশ্যই, কিন্তু সেসব হিসাব মেলাতে যাওয়া অভব্য ভাবনায় কারোর পক্ষে আর সম্ভব হয় না। একটি সমাজ যখন শত শত বছর থেকে গড়ে ওঠে, তখন অতল খুঁজতে যাওয়া মানুষগুলো তার ‘skill’ ভুলতে বসে; তখন ‘know-how’-তে একটি একটি করে সবকিছু ছুড়ে ফেলতে  হয়। জাঁ পল সার্ত্রেও পেরেছিলেন। তাইতো ‘The age of reason’-এ ম্যাথু দিলারু যখন তার মামার তিন হাজার বছরের প্রিয় ফুলদানিটি সজোরে আঘাত করে সব সংস্কার ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেটিও হয়তো স্তূপ ফেলে দেওয়ার মতো সজোর সম্মোহন। কিন্তু সেখানেও ধুলো জমে যাওয়ার জন্য ফুলের গৌরব ঠিক কতটা শোভা পায়? আর আশা করা কতটা বোকামি সে ভাবনায় কি কেউ বাঁচে! বাঁচে না। সবাই বাঁচতে আসে। কিন্তু কেউ বাঁচে না, এ কথাগুলোর জন্য গণতান্ত্রিক হতে হবে! তাও কি মনের শোভাবর্ধনের জন্য! অথচ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি— অশ্লীলতা, নাস্তিকতা, রাজনীতি কত কিছু আসবে(?)! সেখানে হুমায়ুন আজাদ আসার মতো? এ-কারণে কথাগুলো বলা।

অবশ্যই দানিয়েল দাঁন্তে, ডেভিড মিল, বার্ট্রান্ড রাসেল, ফিলিপ পুলম্যান, অ্যারিটা ক্রিস্টিনা, অ্যাইয়ান হির্জি আলিদের পাশে হুমায়ুন আজাদের নামটি উচ্চারণ করা যায়। হুমায়ুন আজাদ ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, এলিয়ট, দাঁন্তে, ইয়েটস্, বার্নার্ড শ’, র্যাবো, হাইনে, গ্যাটে, বদলেয়ার, হুইটম্যান, মালার্মে, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ফ্রস্ট থেকে শুরু করে কাতুলুজ, শ্যাফো, কিটস, ই ই কামিংস, ডিলান টমাসদের চিন্তার জগত ঘুরে দেখেছেন। কিন্তু তিনি কোনো চিন্তাকে নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। বিখ্যাত জাতিসত্তা এবং তাদের চিন্তা যখন একটি কালধারায় অতিক্রম করে ধ্যান-জ্ঞানে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে নির্বিশেষ, তখনো হুমায়ুন আজাদ সেটি উৎস বা আকর ভেবেও শুধু মেনে নেননি। তাকে কখনো কখনো অস্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হননি। তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলির কবিতা নিয়ে বলেছেন, ‘হূদয় তাঁদের কাছে শুধু সুখ-দুঃখের উৎস হয়ে থাকে না, হূদয় হয়ে ওঠে তাঁদের জ্ঞানের প্রত্যঙ্গ। আগে হূদয় ছিল না, ছিল মন; মনকেই মনে করা হতো মানুষের নিয়ন্ত্রক; তাঁরা মনের জায়গায় স্থান দেন হূদয়কে।’ আবার তিনি রবীন্দ্রনাথকে শুধু শ্রেষ্ঠ কবি নন, কবিদের রাজাও বলেছেন এভাবে, ‘তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমার মনে হ’তে থাকে ওই পুরুষ কোনো পৌরাণিক পুরুষ নন, রাজা নন; তিনি কবি, কবিদের রাজা, তার নাম রবীন্দ্রনাথ।’ হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথের প্রায় চার হাজার কবিতা ও গান পুনর্মূল্যায়নে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন তেমনি রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘আমি বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি। তিনি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং প্রাবন্ধিক। কিন্তু তাঁর সমস্ত বিশ্বাসের আমি বিরোধী। তিনি যে রোমান্টিক কবিতা লিখেছেন, সেগুলো সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ; আমি তার খুবই অনুরাগী। কিন্তু তিনি যে প্রভুতে বিশ্বাস করতেন, বিধাতায় বিশ্বাস করতেন, পথের শেষ কোথায় ব’লে হাহাকার করতেন এবং মনে করতেন সমস্ত কিছু বিধাতা ক’রে দিয়েছেন। এই সমস্ত বাজে বিশ্বাস আমি পোষণ করি না। রবীন্দ্রনাথের বহু বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করি, কিন্তু তাঁর কবিতা উৎকৃষ্ট রোমান্টিক কবিতা। মনে রাখতে হবে তিনি রোমান্টিক কবি।’

হুমায়ুন আজাদ ছিলেন মনেপ্রাণে একজন খাঁটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার জ্ঞান তাপস। তার জ্ঞান সাধনার উদ্দেশ্য যেমন ছিল অসাম্প্রদায়িক তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সারা জীবনই সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তিনি কোনো ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেননি। প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে উদ্গত হয় ধর্মীয় বিদ্বেষ। আর ধর্মীয় বিদ্বেষ কখনো কোনো সমাজের মঙ্গল বয়ে আনে না। আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীতে ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে বয়েছে রক্তগঙ্গা, ধ্বংস হয়েছে সমাজ সভ্যতা, মানবতা হয়েছে উৎপাটিত ভূলুণ্ঠিত। তবে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা কখনো এক নয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু তার জন্য সংঘর্ষ হওয়াটা মানব সমাজের জন্য যেমন কাম্য নয় তেমনি ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকাও বাঞ্ছনীয়। বিখ্যাত মনীষী রিচার্ড ডি. ল্যামবার্ট মনে করতেন, ‘কারো নিজ ধর্মের প্রতি গর্ববোধ সাম্প্রদায়িকতা নয়, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করাটাই সাম্প্রদায়িকতা।’ তবে আমরা দেখি, ধর্মীয় মৌলবাদ বিষয়ে হুমায়ুন আজাদের অবস্থান ছিল খুবই স্পষ্ট। তিনি মৌলবাদের পরিণতি ও তার বিষবাষ্প রুখে দেওয়ার, সতর্ক ভঙ্গির উচ্চারণে বলেছেন, ‘...পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর ভাবাদর্শ মৌলবাদের, উদ্ধত ফণা কচলে দেয়ার জন্যে বিজ্ঞানচেতনায় জারিত প্রতিটি নাগরিককে তৎপর হ’তে হবে।’

তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, হুমায়ুন আজাদের লেখা না পড়ে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউ কেউ তার বিরোধিতা করেন। বাস্তবে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একজন নিখাদ জ্ঞান সাধক। তার ছিল চিন্তার অভিজাত। চিন্তার এ আভিজাত্য অর্জন করতে হলে মানুষকে প্রাণ খুলে মানুষ হতে হয়। জগতের সব মনীষী চিন্তার রাজ্যে সঙ্কীর্ণতাকে প্রতিবন্ধক মনে করতেন। সুতরাং হুমায়ুন আজাদের চিন্তাকে স্পর্শ করতে হলে আমাদের সব সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। তবে এ কথা ঠিক যে, হুমায়ুন আজাদ জ্ঞান অর্জনের জন্য ধর্ম-অধর্মের ভেদ নিয়ে হয়তো যতটা পড়াশোনা করেছেন— সে বিষয়ে তিনি সীমিতই লিখেছেন এবং তার সমুদয় লেখা, পড়াশোনার বিষয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা যথেষ্ট রয়েছে— তাতে সন্দেহ নেই। হুমায়ুন আজাদ তার কোনো লেখায় আবেগের আতিশয্যে ভাসেননি। কারণ সত্যনিষ্ঠতা ও যুক্তি তার কাছে ছিল এক পরম ঈশ্বর।

হুমায়ুন আজাদ জ্ঞানকে নির্বিচার ও বদান্যতার মাপকাঠিতে কখনো পরিমাপ করার জন্য ছোটেননি। তার জীবনযাপন ও লেখালেখিতে ছিল সর্বত্র প্রথাবিরোধী ও বিচারধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি সব প্রচল প্রথায় থোড়াই কেয়ার করতেন। এ কারণে তার জগত ছিল পক্ষ-প্রতিপক্ষের উদ্দিষ্ট ও মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু তাতে তিনি কোনোভাবে অন্তর্ঘাত প্রাপ্ত বা বিচলিতবোধ করেননি। কারণ তিনি সচেতনভাবেই জানতেন, যে সমাজের শিরা-উপশিরায় ধর্মীয় মৌলবাদ, দুর্নীতি, অসাম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত; সেখানে জ্ঞানের গ্লানি থাকলেও পরাজয় অবধারিত নয়। জ্ঞান একসময় বিজয়ী হয়। তাই তিনি ছিলেন জ্ঞানের পূজারি। ফলে সবাই ছিল তার শত্রু। তবে জ্ঞান দিয়ে শত্রুতা উপভোগ করতে পারেন মহামনীষীরা, তাতে সন্দেহ কি! সুতরাং তার বহুমুখী সৃষ্টি ও প্রতিভাকে কেউ কখনো প্রতিভার দায়ভারে ছুড়ে ফেলতে পারেননি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads