• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জীবনের রঙ

বিদেশের মাটিতে তো আর দেশের মতো সহজে রক্ত মেলে না

আর্ট : রাকিব

সাহিত্য

গল্প

জীবনের রঙ

  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০১৮

কাজী সুলতানুল আরেফিন   

দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে অয়েজুল হক দেশে ফিরেছেন প্রায় সাত বছর হলো। আজ তাকে খুবই বিষণ্ন মনে হচ্ছে। চার লাখ টাকা ভর্তি কাপড়ের থলেটি আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বাসে চেপে বসেছেন তিনি। উদ্দেশ্য ঢাকা গমন। জানালার পাশে বসেও কেমন অস্বস্তি লাগছে অয়েজুল হকের। যত দ্রুত পারেন ঢাকা পৌঁছে বন্ধু মুজাহিদকে টাকাটা দিতে হবে! কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়েছে। যা হোক, কিছুটা শান্তি লাগছে এখন। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে। মনে পড়ে গেল সিঙ্গাপুরের সেই দিনগুলোর কথা। বন্ধু মুজাহিদের সাথে কাটানো সেই দিনগুলো। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ছাড়া কিছুই খেত না, কোথাও যেত না। তবে মুজাহিদের সাথে পরিচয়টা ছিল ভিন্নভাবে। মুজাহিদ দুর্ঘটনায় পড়লে অয়েজুল হক রক্ত দিতে এগিয়ে আসে। বিদেশের মাটিতে তো আর দেশের মতো সহজে রক্ত মেলে না। তাই রক্ত পেয়ে সুস্থ হওয়ার পর অয়েজুল হককে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল মুজাহিদ। এসব ভাবতে ভাবতে দুচোখ ছলছল করে উঠল অয়েজুল হকের। আজ তিনি বন্ধুর জন্য সাধের জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।

অয়েজুলের মনে হয় বাস খুব ধীরে চলছে। বাসের সিটে হেলান দিলেন অয়েজুল হক। ঝিমুনি আসছে তার। ঝিমুতে ঝিমুতে ভাবছেন তিনি, কী এমন হলো যে, ছেলে আমেরিকা থেকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে তার শ্বশুর অর্থাৎ অয়েজুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাহিদ সাহেবকে চার লাখ টাকা দিতে বলল! অবশ্য ছেলের কথায় চার লাখ টাকা কিংবা সাধের জমি খোয়াতে অয়েজুল হকের কোনো আফসোস হচ্ছে না। কারণ ছেলে বিগত কয়েক বছরে আমেরিকা থেকে টাকা পাঠিয়ে অয়েজুল হকের ষোল লাখ টাকা কর্জ পরিশোধ করেছে। ছেলেকে নিয়ে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। চোখবুজে ছেলের বিয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। মুজাহিদের বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে শুনে তিনিও জানিয়েছিলেন তার একটা বিয়ের উপযুক্ত ছেলে আছে। এ কথা শুনে মুজাহিদ দুহাত চেপে ধরেছিলেন অয়েজুল হকের। তিনিও আর না করতে পারেননি। তবে মেয়ে একখান মুজাহিদের। যেমন ভদ্র, নম্র তেমনি রূপসী আর গুণবতী। বিয়ের পরে অয়েজুল হকের সকল আত্মীয়স্বজনের মুখে কেবল বউয়ের সুনাম। বউ ধার্মিকও বটে। অয়েজুল হক এমন পুত্রবধূ পেয়ে মুজাহিদকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদেছিলেন। এমন ভাগ্যবতী বউ পাওয়ার দু’মাসের মধ্যে অয়েজুল হকের ছেলে ডিভি লটারি জিতে নিল। এ যেন নতুন বৌয়ের ভাগ্য। তারপর অয়েজুল হকের ছেলে শামিম বউ নিয়ে আমেরিকা।

এসব ভাবতে ভাবতে অয়েজুল হক কখন যে ঢাকা পৌঁছে গেছেন তা টের পাননি। পথে মুজাহিদের সাথে মোবাইলে একবার কথা হয়েছিল। তিনি আসছেন তা জানিয়েছিলেন। মুজাহিদ বাস স্টেশনে থাকবে বলেছে। বাস থেকে নেমে অয়েজুল হক ডানে বামে চোখ ফেরাতেই মুজাহিদকে দেখতে পেলেন। হাসিমুখে অয়েজুল হক বন্ধুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। মুজাহিদও এগিয়ে আসছে, তবে মুজাহিদের মুখ বেজার করা। চেহারায় রাজ্যের অন্ধকার ভর করেছে। কাছে এসেই মুজাহিদ বলল, ‘টাকা কোথায়?’ বন্ধুর এমন আচরণে অয়েজুল হক ভীষণ কষ্ট পেলেন। কুশল বিনিময় পর্যন্ত করল না! অয়েজুল হক থলেটা মুজাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মুজাহিদ সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে হন হন করে চলে যেতে লাগল। মুজাহিদ কোনো কিছু জানতে বা জানাতেও চাইল না। অয়েজুল হক নির্বাক হয়ে গেলেন। সেদিন রাতে অয়েজুল হক হোটেলে কাটিয়ে পরদিন বাড়ি ফিরে গেলেন। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার স্ত্রী যদি কিছু বুঝতে পারে, তাহলে কষ্ট পাবে। তাই বাড়ি গিয়ে সব কিছু চেপে গেলেন। স্ত্রীকে বানিয়ে বানিয়ে বন্ধুর বাড়িতে আপ্যায়নের কথা আর রাত্রি যাপনের গল্প করলেন।

অয়েজুল হক দিন দিন খুবই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। এরই মধ্যে ছেলে শামিম ফোন করে বলেছে, সামনের মাসেই সে বউ নিয়ে আমেরিকা থেকে বেড়াতে আসছে। দিন আর সপ্তাহ শেষে অবশেষে অয়েজুল হকের ছেলে শামিম বউ নিয়ে আমেরিকা থেকে বাড়ি আসে। অয়েজুল হকের মনে স্বস্তি আসে এবার তিনি আসল ঘটনা জানতে পারবেন। দু’দিন তিনি কিছুই বললেন না। তবে খেয়াল করে দেখলেন শামিম সেই পুরনো শামিমই। তার কোনো পরিবর্তন নেই। সবার সাথে মায়া মমতায় জড়িয়ে থাকে। তবে বউটা মনে হয় আগের মতো নেই। একা একা থাকে। কেমন জানি অন্যমনস্ক  হয়ে গেছে। অয়েজুল হক একদিন ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে বাজান কি সমস্যা আমারে জানাবি না?’  শামিম কোনো কথা বলে না। দুদিন বাদেই শামিমের বউ কাউকে কিছু না বলে বাপের বাড়ি বেড়াতে চলে গেল। এসব দেখে অয়েজুল হক খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। ছেলের বউ চলে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় ডাকযোগে একটা ডিভোর্স লেটার আসে। অয়েজুল হকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তবে শামিমের কোনো অনুভূতির পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেন এটাই স্বাভাবিক!  এবার আর অয়েজুল হক চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি শামিমকে চেপে ধরলেন, কী সমস্যা জানার জন্য। অগত্যা শামিম বলতে বাধ্য হয়।

কয়েক বছর ধরে শামিমের স্ত্রী প্রথমে আমেরিকাতে চাকরি করার বায়না ধরে। শামিম বোঝায়, একজনের কামাই যদি যথেষ্ট হয় তাহলে ‘তুমি চাকরি করবে কেন?’ এরপর তার বউ বায়না ধরে শামিমের আয়ের সব টাকা তার বাবার ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে হবে। শামিম নিজ পরিবারে কোনো টাকা দিতে পারবে না। এ কথাটা শামিম মানতে পারেনি। অয়েজুল হক এবার চার লাখ টাকার বিষয় জানতে চান। শামিম জানায়, আমেরিকা যাওয়ার সময় শ্বশুর তাকে খরচ বাবদ চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সে বাবদ শামিম প্রায় সাত বছর ধরে প্রতিমাসে শ্বশুরকে সংসারের খরচ বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা করে দিত। এ পর্যন্ত সে পঁচিশ লাখ টাকার উপরে শ্বশুরকে দিয়েছে। তার ধারণা ছিল সরাসরি চার লাখ টাকা ফেরত দিলে হয়ত শ্বশুর মনে কষ্ট পাবে। তাই সে মাসে মাসে সংসারের খরচের কথা বলে দিত। কিছুদিন আগে শ্বশুর তার কাছে কল করে চার লাখ টাকা ফেরত চায়। শামিমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। শ্বশুর এও জানায় যে, শামিম এতদিন যে টাকা দিচ্ছিল তা ছিল ওই চার লাখ টাকার সুদ। ছেলের মুখে এসব কথা শুনে অয়েজুল হকের বুকের একপাশটায় চিন চিন ব্যথা করে ওঠে।

তবে এসব করার কী কারণ শামিম কিছুই জানে না। যা হোক, দেনমোহরের টাকা শোধ করে শামিম খুব দ্রুত আমেরিকা ফিরে যায়। দেশে থেকে সে তার বাবার সামনাসামনি হতে পারছে না। তার বাবা অয়েজুল হকও ছেলের এমন দুর্ঘটনার জন্য ভেঙে পড়েছেন। যেহেতু শামিমের ডিভোর্স দেওয়া স্ত্রীর ভিসা ছিল সেও কিছুদিন পর আমেরিকা ফিরে গেল। আমেরিকা ফিরে যাওয়ার পর সব রহস্য খোলাসা হলো। শামিম বুঝতে পারে পর্দার আড়ালের ঘটনা। একদিন পাশের বাসার বারান্দায় শামিমের চোখ আটকে যায় তার তালাকপ্রাপ্ত বিবিকে দেখে। এই সহজ-সরল মেয়ের ভালোবাসার রঙ বদলানোর কারণ এতক্ষণে সে বুঝতে পারল। বউয়ের সময় ভালো কাটবে বলে শামিম সাগরের বিচের পাশে বাসা নিয়েছিল। ওই বিচে তার স্ত্রী প্রায় সময় কাটাতে যেত। যে ছেলেটির সঙ্গে এখন তার তালাক দেওয়া স্ত্রী বসবাস শুরু করেছে, সে ছেলেটা অনেক বিত্তশালী। শামিম তাকে একটুআধটু চিনত। শামিম বুঝতে পেরেছে লোভে পড়ে তার স্ত্রী তাকে ধোঁকা দিয়েছে আর তার বউয়ের পরিবার সেটা জানত। তাই তো এত ছলচাতুরী!

শামিম রংধনুর দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায়। আর ভাবতে থাকে আকাশের নীড়ে কীভাবে সাতরঙ এক হয়ে ঢেউয়ের মতো খেলা করে। কিন্তু এই মানবজীবনে কখনো সাতরঙ এক হতে পারে না কেন সেটা তাকে ভীষণ ভাবায়। শামিম প্রজাপতির পাখার রঙ দেখেও ঠিক একইভাবে ভাবতে থাকে। কী সুন্দর তাদের পাখার রঙের মিশ্রণ! দেখার সাথে সাথে আমাদের মন কেড়ে নেয়। অথচ জীবন শুধু রঙ বদলায়। কেন বদলায়? রংধনুর মতো অথবা রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে সুখময় কোনো জীবনের স্বপ্ন আঁকতে পারে না সে!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads