• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সোনালী কাবিনের অন্তর্গত টান

সোনালী কাবিন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন মিথস্ক্রিয়ার দলিল

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

সোনালী কাবিনের অন্তর্গত টান

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক স্বপ্নভঙ্গ অতিদ্রুতই ঘটতে থাকে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, চোরাকারবারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্য— একবাক্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার অভাব স্বাধীনতার সব সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে শ্রেণিদ্বন্দ্বের সকল মানসচরিত্র উন্মোচিত করেন কবি আল মাহমুদ তাঁর সোনালী কাবিন কবিতাগ্রন্থে। যদিও এর রচনাকাল শুরু হয়েছে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে এবং শেষ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে। তথাপি স্বাধীনতা-উত্তর মনোবৈকল্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্ভিক্ষ এবং সর্বোপরি যাপিত জীবনের হতাশ্বাস এ কাব্যের শরীরে বিশেষত সোনালী কাবিন শীর্ষক সনেটগুলোতে বিদ্যমান। উপরন্তু রয়েছে নাগরিক ঐশ্বর্যের প্রাণহীন পটভূমির বিপরীতে লোকজ উৎসের ক্রমাগত স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল উপস্থিতি। আর এসবের ভেতর দিয়ে প্রিয় মানবীর কাছে প্রকৃত সত্যের ওপর নির্ভর করে কবি ব্যক্তিজীবনের মূল সারাৎসারটি উন্মোচন করেছেন, যেখানে কল্পনাও ডানা মেলেছে প্রকৃত জীবনযুদ্ধের বাস্তবতার নিরিখে।

সোনালী কাবিন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন মিথস্ক্রিয়ার দলিল। বাস্তবতা এবং সমস্যার জাঁতাকলে জীবন-মৃত্যু-প্রেম ওই শ্রেণির জন্য নিয়ম-বিরোধী ও মূল্যবোধ-বিরোধী বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই বিরোধ বিপ্লবাত্মক পথ পরিহার করে বরং লিরিক সুষমার মানবিকবোধের গভীরতায় উৎকীর্ণ। ফলে বিশুষ্ক নাগরিকতায় দীর্ণ অথচ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সূত্রে লোকজ মিথের নান্দনিক ব্যবহারে এ কাব্যের গোপন সত্য ও সৌন্দর্য পারস্পরিকতায় অভিনব হয়ে উঠেছে। বিশেষত সোনালী কাবিন শীর্ষক সনেটগুলোতে শব্দচয়ন ও এর ব্যবহার এবং আহ্নিক জীবনের চিরন্তন বিষয়ের উন্মোচনে শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে স্বল্পজীবী মানুষের জনপদ ও তার সম্ভাবনা মৌলিকত্ব লাভ করে।

সোনালী কাবিন কাব্যে নারী-প্রকৃতি-প্রেম ও মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তোলা জগতের পাশাপাশি সত্য ও সৌন্দর্যের বিশ্বাসের পটভূমি বিস্তার লাভ করেছে। মূলত এই কাব্যের অন্তর্গত টান হচ্ছে বৈশ্বিক ও দেশীয় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক অবদমনের ভেতরে মানবমনের হঠকারী বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ। অন্যদিকে কবি এ কাব্যের মাধ্যমে মানবের বোধের জগতে নান্দনিকতার ধূসর লোকালয় এবং রক্তমাংসের সুস্থ সজীবতায় এক দ্বিধামুক্ত জীবননিষ্ঠ প্রজ্ঞাকে উন্মুক্ত করেছেন। একইভাবে সোনালী কাবিনের কবিতাগুলো একটি স্বল্পজীবী বিশেষ জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সুবিশাল পরিসরে ব্যাপ্তি লাভ করেছে তার উৎস সন্ধানের ঐকান্তিকতায়।

কবির এই যে উৎস সন্ধান— সেখানে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন জীবনের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে জীবন ও শিল্পের সংজ্ঞার্থে পরিণত হয়েছে। এমনকি আত্মবিচ্ছিন্নতা ও সত্তাবিচ্ছিন্নতার আউটসাইডার বোধ থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষাও পরিব্যাপ্ত হয়েছে ‘সোনালী কাবিন’ শীর্ষক কবিতাগুলোতে। সোনালি কাবিনের ভেতরে লক্ষ করি এর উত্তম পুরুষ সত্তাসংকটের টানাপড়েনে জর্জরিত। সামনে দিকচিহ্নহীন সময়ের এক মহাগর্ভ। তথাপি জীবন ও শিল্পের জন্য নিগূঢ় মহাকালের কাছে দর্শন সঞ্জাত অস্তিত্বের প্রশ্নে সচেষ্ট। সংসারের বন্ধুর যাত্রাপথে জীবনের বহুমাত্রিক অনুভবের তীব্রতা নিয়ে জীবনকে সততার সঙ্গে অনুধাবনের একটি বিচার বিশ্লেষণের যৌক্তিক ব্যাখ্যা কবি আল মাহমুদ এখানে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সেই জীবন-জিজ্ঞাসা এবং তার সর্বমুখী অন্বেষা সোনালী কাবিনের আধুনিকতাকে প্রকাশ করেছে। এই আধুনিকতা ব্যক্তিত্ববাদী আমিত্বের জয়গানের ভেতর দিয়ে তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র এবং লোকাচার ও সংস্কৃতিকে প্রচ্ছন্ন করে তুলেছে।

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,’— সোনালী কাবিন কাব্যে এর অন্তর্গত টান হচ্ছে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের প্রতি সমাজের অবজ্ঞা ও অনাদর। সেই দ্বাান্দ্বিক সূত্রে দাঁড়িয়ে কাব্যের উত্তমপুরুষ শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়টিকেও ঘরের মানবীর কাছে উন্মোচন করেন। এখানে শূন্যতাবোধ ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। সমাজব্যবস্থায় বিবিধ অসঙ্গতি ও অসম বিধিব্যবস্থার স্বরূপও উঠে এসেছে। তবে এ কাব্যের একটি প্রধান গুণ হচ্ছে এর লৌকিক ভাষার সঙ্গে আছে লোকজীবনের স্বীকৃতি। ফলে এখানে ব্যক্তি ও সমাজের বাস্তবচিত্রই প্রধান হয়ে উঠেছে।

সোনালী কাবিন সনেটগুচ্ছে অতীতের বর্ণনার ভেতরেই বর্তমান ধরা পড়ে, কেননা অতীতকে কবি স্মৃতিকাতরতা নয় বরং অতীতের পটভূমিতে দেখেছেন। প্রতীকী ভাষণ, নিখুঁত বর্ণনার মধ্য দিয়ে কবি আল মাহমুদ এর কথক উত্তমপুরুষের মাধ্যমে আবহমান বাঙালির মানসচরিত্র, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পুরাণ সবকিছু উন্মোচন করেছেন, ইতিহাসের মধ্যে হূদয়ের ইতিহাস গেঁথে দিয়েছেন। সেই মহাসত্যের সুমুখে এসে দাঁড়িয়েছে এই জনপদ, শস্য ও হূদয় এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিষবাষ্প ও পুঁজিবাদী রাজনীতি।

‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছে যতই বলা হোক এর ঐতিহ্য, পুরাণ, শব্দপ্রয়োগ বা আঞ্চলিক শব্দের সার্থক ব্যবহারের কথা কিংবা এর খাঁটি ছন্দের ঝংকার যতই তোলা হোক না কেন, কার্যত এ এক ব্যাপক ঊর্ণিনাভ সমাজব্যবস্থার বিপরীতে সাম্যবাদের কথাই এখানে জোরালোভাবে ধ্বনিত হয়েছে। শ্রেণিবৈষম্যের বেড়াজাল ভেঙে শ্রেণিদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সব মানুষকে এক কাতারে আনার স্বপ্ন এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। আর সে বিষয়টি সোনালী কাবিনের ছয় নম্বর সনেটে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে, ‘মাৎ‌স্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক/সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,/কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক/শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ’পরে।/পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস/বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,/সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।/মুখ ঢাকে আলাওল— রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।/এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল? আরশি নগরে খোঁজা বাস করে পড়শী যে জন/আমার মাথায় আজ চূড়ো করে বেঁধে দাও চুল/তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন,/অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে এ যাবৎ‌ করেছি যে ভুল/সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কূজন।’

এখানে কবির উপলব্ধি তিনি যেন কৌম সমাজের লোক। নারীর হূদয়ে গভীর ব্যঞ্জনায় ঢেউ তুলেছেন। এই ঢেউয়ের দোলাচলে কখনো ডুবেছে, আবার ভেসেছে ব্যথাতুর এ হূদয়। অথচ নারী-পুরুষের প্রেমের মুগ্ধতা চিরকালীন। এই প্রেম-অপ্রেম খেলা এখনো চলছে নগরে নগরে। নারীকে নিয়ে আমাদের যত বন্দনা ততটা নেই সামন্ত সমাজ নিয়ে। জননী-জায়া-কন্যা, প্রেয়সী নানা মাত্রায় উদ্ভাসিত নারীর ভেতেরেই কবি আবিষ্কার করেন মুক্তি। আর এই মুক্তি আমাদের সামনে এসেছে একাত্তরের সংগ্রামের মাধ্যমে। এর বাইরেও কবি মুক্তি খুঁজেছেন নারীর আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভেতরে।

প্রত্যেক কবির সত্তা ও স্বভাবে প্রজ্বলিত হতে থাকে তাঁর ফেলে আসা জনপদ— হোক সে শহর কিংবা গ্রাম। কবি আল মাহমুদ সেখানেই উজ্জ্বল কিন্তু ব্যতিক্রম নন। সোনালী কাবিন কাব্যে সুন্দরের পূজারি কবির সেই উজ্জ্বলতাই ধরা পড়েছে। সাম্যবাদী রাষ্ট্রের সাধনায় সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে কবি মাটি ও মানুষের হূদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। আর এখানেই কবি বৈশ্বিক চেতনাকে ধারণ করেন। নিজ দেশ, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি ছাপিয়ে কবি যেন বৈশ্বিক হয়ে ওঠেন। স্বদেশের মাটি ও ধুলো সর্বাঙ্গে মেখেই ‘সোনালী কাবিন’-এ নিপীড়িত মানুষের কথা ধ্বনিত হয়েছে। আর এভাবেই কবি আল মাহমুদ সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ভাষার কাব্যজগৎ। বাঙালি পাঠকও আজ অব্দি কবির ‘সোনালী কাবিন’-এর মোহগ্রস্ততা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। কবির জীবদ্দশায় তো বটেই, হয়তো তাঁর মৃত্যুর পরেও আরো কিছুকাল রয়ে যাবে এই ঘোর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads