• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
উল্টাপাল্টা পাঠ

প্রতীকী ছবি

সাহিত্য

উল্টাপাল্টা পাঠ

  • মাসুদুজ্জামান
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

একুশের বইমেলা। একটি বই হাতে নিয়ে দেখছিলেন এক পাঠক। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বইটি হাতে নিয়ে প্রথমে তিনি কভারটা দেখলেন। তারপর একেবারে পাতা উল্টে চলে গেলেন শেষ পৃষ্ঠায়। স্বগতোক্তি করে বলতে থাকলেন, ‘কোনো বইয়ের শেষটা ভালো না লাগলে সেই বই আমি পড়ি না। আর ভালো না লাগলে কেনই-বা পড়ব?’ আর্হেন্তেনিও হুলিও কর্তাজার কি এ ধরনের পাঠকের কথা ভেবে তার বহুল আলোচিত ‘হপস্্কচ’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন?

কর্তাজার, অনেকেই জানি, এসপানোল ভাষার বিশ্ববিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। ভাবলে অবাক হতে হয়, বইটি প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ৫৫ বছর আগে। কর্তাজার তো আরো সাহসী হয়ে পাঠককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দুভাবে পড়তে। প্রথমত, প্রথাগতভাবে আমরা যেমন পড়ি, অর্থাৎ প্রথম অধ্যায় থেকে ৫৬তম অধ্যায় পর্যন্ত পড়ার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত বলেছেন, ৭৩তম অধ্যায় থেকে উপন্যাসটি পড়া শুরু করে সর্বশেষ ১৫৫তম অধ্যায় পর্যন্ত পড়ে যান। তবে এই পাঠযাত্রাটি ৭৩ থেকে ৭৪, ৭৪ থেকে ৭৫— এভাবে নয়। পড়ার ক্রমটা তিনি সাজিয়ে দিয়েছেন আরো এলোমেলোভাবে : ৭৩-১-২-১১৬-৩-৮৪-৪-৭১-৫-৮১... এইভাবে।

আমার এই জার্নালটি যারা পড়ছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অধ্যায়ের ক্রমানুসারে পড়ার রীতিটি পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছেন কর্তাজার। যেমন উপরের ক্রমটা দেখুন, ৭৩ সংখ্যক অধ্যায়টি পড়ে প্রথম অধ্যায়টি পড়তে বলেছেন। আবার প্রথম অধ্যায়ের পর দ্বিতীয় এবং এই অধ্যায়ের পর ১১৬তম অধ্যায়টি পড়তে বলেছেন। এইভাবে ক্রমটা আরো পরে আরো এলোমেলো করে দিয়েছেন কর্তাজার। বলা বাহুল্য, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, হে পাঠক, আপনার যেমন খুশি বইটি পড়ুন। যেখান থেকে খুশি পড়া শুরু করুন, যেখানে খুশি থামুন। আবার যেখানে থামলেন সেখান থেকে আগের যে অধ্যায়টি পড়েননি, সেটা পড়তে পারেন। আবার সেখান থেকে যে অধ্যায়টি খুশি সেই অধ্যায়টি পড়ুন। এভাবে যেরকম খুশি উল্টেপাল্টে উপন্যাসটি পড়ুন।

‘হপস্কচ’ উপন্যাসটি পড়ার যে রীতির কথা কর্তাজার বলেছিলেন, সেটা কি জটিল ও দুরূহ মনে হচ্ছে? পাঠক হিসেবে অবশ্য আপনার মনে হতে পারে, এভাবে পড়লে কাহিনীটি বোঝা যাবে তো? প্রথমে অবশ্য এমনটা মনে হতে পারে। কিন্তু না, কর্তাজার বলেছেন, এভাবে পড়লেও উপন্যাসটির গল্প বোঝা যাবে। বোঝা যাবে উপন্যাসটির অন্তর্গত অর্থ। কোনো লেখা, যারা একরৈখিকভাবে উপন্যাস পড়েন, পেতে চান গল্পের আস্বাদ, তাদের প্রতি করুণা অনুভব করেছেন। ‘হপস্কচ’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গেই তিনি বলেছেন, প্রথম অধ্যায় থেকে ৫৬তম অধ্যায় পর্যন্ত টানা পড়ুন। তারপর পরবর্তী ৯৯টি অধ্যায় অগ্রাহ্য করুন, অর্থাৎ পরবর্তী ২০০টি পৃষ্ঠা না পড়লেও হবে, এমনটাই ভেবেছেন কর্তাজার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ঔপন্যাসিক কর্তাজার তাহলে কেন ৫৬৭ পৃষ্ঠা সংবলিত এত বড় একটি উপন্যাস লিখলেন? উপন্যাসটির প্রকৃত পরিসরই-বা কতখানি? অর্থাৎ কোথা থেকে উপন্যাসটি শুরু হবে এবং কোথায় শেষ হবে? উপন্যাসটি পড়তে গেলে এই প্রশ্নগুলো পাঠক হিসেবে আপনার মনে জাগবেই। ৯৯টি অধ্যায় যদি আপনি না পড়েন, তাহলে কোনো কিছু কি হারাবেন না?

এর উত্তরও পাওয়া যাবে ‘হপস্কচ’-এর একটি চরিত্রের মাধ্যমে। চরিত্রটি একটি অপ্রধান চরিত্র। নাম মরেল্লি। এই চরিত্রটিই কাহিনীর সূত্র ধরে নতুন ধরনের ‘অপ্রথাগত’ উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠায় এর বর্ণনা দিয়েছে। উপন্যাসটির ন্যারেটিভ যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো, সেই ন্যারেটিভের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছে। উপন্যাসটির চূর্ণ-বিচূর্ণ এই অংশগুলো আসলে খণ্ডিত এলোমেলো কিছু নয়। এর একটি দার্শনিক দিক আছে। এই দার্শনিক দিকটিই উপন্যাসটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। সক্রেটিস-পূর্ব ‘ইলিয়েটিক’ (ঊষবধঃরপ ঝপযড়ড়ষ) দার্শনিক ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই উপন্যাসটি লিখেছেন কর্তাজার।

কী ছিল সেই দার্শনিক ভাবনাটা, যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কর্তাজার? খ্রিস্টপূর্ব আড়াইশ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক পারমেন্ডিস ও জেনো ছিলেন এই দর্শনের স্রষ্টা। এই ভাবনার মূল কথাটা হলো, ‘সবকিছুই এক ও অভিন্ন।’ বহুত্ব আর পরিবর্তন বলে কিছু নেই। অর্থাৎ আমরা আমাদের বস্তুবিশ্বকে যেভাবে খণ্ড খণ্ড করে দেখি, আসলে তা খণ্ডিত নয়; বরং তা একক ও সমন্বিত রূপের সমাহারমাত্র। আমাদের সত্তার কাছে সবকিছুই সময়হীন আর যৌক্তিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। ফলে আমরা যখন আমাদের চারপাশের বস্তুপৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ভাবি বা দেখি তা বিভ্রমমাত্র, সত্য নয়। কর্তাজার তার উপন্যাসের কাঠামো ও ভাষারূপকে এভাবে অসমন্বিত খণ্ড খণ্ড (অধ্যায়-অধ্যায়) করে নির্মাণ করলেও সব অধ্যায় আর বাক্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। উপন্যাসটির অধ্যায়গুলোকে তাই এগিয়ে-পিছিয়ে পড়লেও যে অর্থ পাওয়া যায়, তা বিচূর্ণ কোনো অর্থ দেয় না। মানব সম্পর্ককে এক ও অভিন্ন বলে ভাবতেন বলেই কর্তাজার উপন্যাসটি এভাবে লিখেছেন। এটিই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ মানবিক রূপ, যার প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে।

পাঠক হিসেবে আমরা অবশ্য ভুলে যাইনি যে, উপন্যাস খণ্ড খণ্ড করে বা বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করে লেখা হয়। শুধু উপন্যাস নয়, মহাকাব্যের কথা যদি বিবেচনা করি, তাহলে ‘মহাভারত’, ‘গিলগামেশ’-এর গল্পগুলোও এলোমেলোভাবে লেখা বা যুক্ত। ‘হপস্কচ’ উপন্যাসটি, বলতে পারি, এসব রচনাকেও কাঠামোগতভাবে ছাড়িয়ে গেছে। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন রচনা। কাহিনীটি একবার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, আরেকবার কুয়াশা এসে ঘিরে ধরে। কর্তাজারই এভাবে বেশকিছু অবিস্মরণীয় ঘটনার উপস্থাপন ঘটিয়েছেন এই উপন্যাসে। হিচককের চলচ্চিত্রের মতো ঘটনাগুলো পাঠককে তীব্রভাবে তাড়িত করবে। মানবিক অস্তিত্বের আখ্যান হিসেবে ‘হপস্কচ’ নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উপন্যাস। উত্তর-আধুনিক নান্দনিক উপন্যাস হিসেবে সার্ত্রে ও কামুর পাশাপাশি কর্তাজারের নামও মহান এক ঔপন্যাসিক হিসেবে উল্লিখিত হবে। যেভাবে খুশি এবং যেখান থেকে খুশি, উপন্যাসটি পড়া যাবে। বহুবিচূর্ণ বিপ্রতীপ পাঠ থেকে মানবিক চৈতন্যকে এভাবেই ছুঁয়ে দিতে চেয়েছেন হুলিও কর্তাজার। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads