• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
গড়াই নদীর ইলিশ

প্রতীকী ছবি

সাহিত্য

গড়াই নদীর ইলিশ

  • মনোজিৎকুমার দাস
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কলকাতা থেকে কার্তিক সেন তার জমিদারি সেরেস্তার নায়েবকে লিখেছেন, ‘শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারি কাচারিতে আসিতেছি। জানিপুরের ঘাটে বোট রেডি রাখিবে। খোকসা রেলস্টশনে রহমত ঘোড়াগাড়ি নিয়া যেন প্রস্তুত থাকে। কত তারিখে গোয়ালন্দ মেলে আসিবো তা পরের চিঠিতে জানাইতেছি।’

এটুকু পড়ে নায়েব মশাইয়ের যেন মাথাটা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রহমত পেয়াদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জমিদার বাবুর চিঠির বাকি অংশে চোখ রাখলেন। কার্তিক সেনের হাতের লেখা যেন ছাপার অক্ষরের মতো। ‘ললিত, তুমি হয়তো এটা জেনে অবাক হবে এই ভেবে এ সময়ে কলকাতার বালিগঞ্জ ছাড়িয়া আমার মতো ফুলবাবু জলজঙ্গলে ঘেরা জমিদারির তদারক করিতে বাঙাল দেশে যাইতে মনস্থ করিতেছি কেন। তবে শোন, চক্রদহের মিলনবাবু ঘোড়ার রেসে আমাকে এক হাত দেখানোর পর... তিনি আমাকে বললেন, ‘ঘোড়ার রেসে হারজিৎ আছে। মন খারাপ করিবেন না। আমি বর্ষার সময় আমার জমিদারিতে ফিরে যাব। বর্ষা শুরু হলে তো রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় বন্ধ হয়ে যাবে। আসুন না কার্তিক বাবু, বাঙাল দেশের বর্ষা দেখে আসবেন। আপনার নায়েব গোমস্তারা তো বাজার থেকে কিনে পদ্মার ইলিশ  আপনাদের খাইয়ে আসছে। গড়াই নদীর ইলিশ তো ওরা আপনাদের খাওয়ায়নি, আর শাংলে জালে গড়াই নদীতে ইলিশ ধরার কী যে আনন্দ!

শ্রাবণের শেষদিকে জমিদারি দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়ে নায়েবকে চিঠি দিন। আমিও থাকব। আসুন, গড়াই নদীতে ইলিশ ধরা যাবে। তাই আমি বর্ষাকালে আসিতেছি।’ চক্রদহের জমিদার মিলনবাবু ঘোড়ার রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও কিন্তু এক গ্লাসের দোস্ত। তাই মিলনবাবুর প্রস্তাবে কার্তিক সেন এক কথায় রাজি।       

জমিদার কার্তিক সেনের চিঠির সবটা পড়ে ললিত নায়েব বিড়বিড় করে বললেন, এ দেখছি বড় একটা ল্যাঠা! রহমত নায়েব বাবুর কথা ভালোভাবে বুঝতে না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘জমিদারবাবু কি লিহেছেন, খারাপ কিছু!’ ‘জমিদারবাবু আসছেন এ মাসের শেষ দিকে...’ বিরক্তি সহকারে ললিত নায়েব রহমতের কথার জবাব দেন। ‘কী কন! নায়েব বাবু, তিন মাস তো হয়নি তিনি আসি গেলেন, আবার আসতিছেন ক্যানে বর্ষাবাদলার মধ্যি! বানের জলে ধানপান ধৌত হইছে ইবার, কনথিকে তারা নজরানা দিবে নে!’

রহমতের কথা শুনে নায়েব মশাই পিয়াদার ওপর ঝামটা মেরে ওঠেন এই বলে, ‘নিজের চরকায় তেল দাও গে, রহমত। জলবর্ষায় জমিদারবাবু এলে পাড়ে তোমার কাজ বেড়ে যাবেনে ভাবে দেখিছ। বাবু এবার গড়াই নদীতে ইলিশ শিকারে আসছেন।’ নায়েব বাবুর কথা শুনে রহমত বলে উঠল, ‘সে তো ভালো কতা! হানুগাঙেও তো বেজায় বান ডাকিছে। সুদোরপুরের কফিল মোড়ল নাকি ছাকনা জালে হানুগাঙ থিকে ইলিশ ধরিছে গত পরশু।’

অবশেষে কার্তিক সেন গড়াই নদীর ইলিশ শিকারের জন্য এসে উপস্থিত হলেন। কার্তিক সেন এর আগেও গড়াই নদীপথে কলকাতা থেকে জমিদারি তদারকিতে এসেছেন, এবারই প্রথম বর্ষাকালে এখানে আসা। বর্ষাকালের প্রমত্তা গড়াইকে এবারই তিনি প্রথম দেখলেন। এবার যেন কার্তিক সেন গড়াই নদীকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন। রহমত ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে খোকসা রেলস্টেশনে গোয়ালন্দ মেইল আসার অপেক্ষায় ছিল। স্টেশনে ট্রেন ভিড়তে সে দূর থেকেই দেখতে পেল ফার্স্ট ক্লাস কামরার জানালায় জমিদারের মুখ।

রহমত জানিপুরের গড়াই নদীর ঘাটে নৌকা রেডি করে রেখেছে। জানিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বেশি দূর নয়। পদ্মা আর গড়াইয়ের মাঝামাঝি স্থানে শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথ বোটে যেমন পদ্মা নদী দিয়ে চলতেন, তেমনভাবে গড়াই নদী দিয়েও চলাচল করতেন। কার্তিক সেনের মনে পড়ল গীতাঞ্জলির অনেক কবিতা জানিপুর গড়াই নদীর ঘাটে বসে লিখেছিলেন।

কার্তিক সেন একসময় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন, পড়াশোনা শেষ করা সম্ভব হয়নি। কার্তিক সেনের বাবা ভুবন সেন সোনার বেনে। সোনার বেনেদের অনেকেই সেকালে সোনা-রুপার তেজারতি করে কোটিপতি হয়। ভুবন সেনকে লাখপতি হওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এ কারণে সে তার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দিকে মন দিতে পারে না। তবে সে তার বড় ছেলে কার্তিককে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিএ ক্লাসে ভর্তি করেছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে একটা ছোট জমিদারি কেনার পর তা দেখাশোনার জন্য তার পড়াশোনা লাটে ওঠে। ঘোড়ার রেসের বাজি, বাইজি নাচ, মদের নেশায় কার্তিক সেনকে পেয়ে বসে।

পাল তুলে দিলে ভাটির টানে ছুটতে থাকল নৌকা। বাঁক ঘুরতেই কার্তিক সেনের চোখ পড়ল পাল তোলা অসংখ্য ডিঙি নৌকা। রহমত বলে উঠল, ‘দেখেন বাবু, নদীর বুকে কত ডিঙি নৌকা। শাংলে জাল পানিতে ফেলে জালের দড়ি ধরে বসে আছে, আর একজন বোইঠা টানছে। ইলিশ জালে আটকালেই জাল টেনে তুলবে।’ জমিদারবাবু ইলিশ ধরার দৃশ্য দেখার জন্য নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। উজান ঠেলে আসা একটি নৌকার দিকে চোখ পড়তেই কার্তিক সেন দেখতে পেলেন দড়ি ধরে বসে থাকা লোকটা আস্তে আস্তে তার হাতে ধরা দড়ি টেনে তুলছে। সত্যি তো, জালে আটকা পড়া বড় সাইজের একটা রুপোলি রঙের ইলিশ জাল থেকে ছাড়িয়ে নৌকার খোলের মাঝে ফেলে লোকটা আবার তার জালটা জলে নামিয়ে দিল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, কতবার জমিদারি দেখতে এ-পথে নৌকায় গিয়েছি, এমন করে ইলিশ ধরার দৃশ্য তো দেখিনি! জমিদারবাবু বলেন, ‘রহমত, ওরা কি নৌকা থেকে ইলিশ বিক্রি করে? বিক্রি করলে কয়েকটা কিনে নেওয়া...’ ‘বলতিছেন কী! আমাগেরে কি কিনে খাতি হবি! রাতির বেলা আমি দুই হালি ইলিশ ধরিছি। তার থিকে এক হালি ইলিশ নায়েববাবুকে দিছি।’ ‘তাই নাকি, রহমত?’ কার্তিক সেনকে নিয়ে রহমত কাচারি বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ালো সন্ধের আগেই। চক্রদহের জমিদার মিলনবাবু ও নায়েববাবু ঘাটে অপেক্ষা করছেন দেখে কার্তিক সেনের মনটা বেজায় খুশি। রাতে রহমতের দেওয়া ইলিশ মাছের নায়েব-গিন্নির রান্না করা নানা পদের ব্যঞ্জন খেয়ে কার্তিক সেন বেজায় খুশি। নায়েববাবুকে বললেন, ‘গড়াই নদীর ইলিশের স্বাদই আলাদা।’ কার্তিক সেন যে কয়দিন কাচারি বাড়ি ছিলেন, সেই কয়দিনই গড়াই নদীতে ইলিশ ধরতে গেলেন রহমতদের সঙ্গে। সঙ্গে মিলনবাবু আর নায়েববাবুরা ছিলেন। তরতাজা ইলিশ ধরা আর নায়েব-গিন্নির হাতের রান্না করা গড়াই নদীর ইলিশের পঞ্চানন খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন জমিদারবাবু কার্তিক সেন। কিন্তু কার্তিক সেনের মনে একটি অতৃপ্তি যেন থেকে গেল। তিনি কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে মিলনবাবুকে বললেন, ‘গড়াই নদীর যুবতী ইলিশগুলোর স্বাদ সত্যিই অপূর্ব। কিন্তু কীসের যেন একটা অভাব...’ মিলনবাবু তার কথা শেষ না করতে দিয়ে বললেন, ‘আপনার কথা বুঝেছি। সামনের বর্ষায় কলকাতা থেকে লছমিদের সঙ্গে আনার ব্যবস্থা করব, আমি কথা দিলাম।’

কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নায়েববাবুকে কার্তিক সেন বলে গেলেন গড়াই নদীর ইলিশের স্বাদ নেওয়ার জন্য প্রতিবছরই বর্ষাকালে এখানে আসবেন মিলনবাবুদের নিয়ে। ৎ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads