• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং মুক্তির প্রসঙ্গ

  • আবুল মোমেন
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। এ আগ্রাসন যে চলছে না তা নয়, কিন্তু অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও রাজনৈতিক স্বার্থে নিছক ধুয়া হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে। আগ্রাসন ঠেকানোর আদত কাজ হচ্ছে না। রাজনীতি বহু বিভ্রান্তির মধ্যে সংস্কৃতি নিয়েও বিভ্রান্ত।

সাধারণত আমাদের রাজনীতিতে আগ্রাসন— সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সম্ভাব্য সামরিক— কথাটি উচ্চারিত হয় ভারতের কথা মনে রেখে। ভারত বিরোধিতাই এ দেশের কোনো কোনো দল ও মহলের প্রধান রাজনৈতিক অবলম্বন। কিন্তু এই ধুয়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসনজনিত সঙ্কটের আসল রূপ তুলে ধরতে পারে না। সেদিকটা আমাদের একবার তলিয়ে দেখতে হবে।

সংস্কৃতির ধর্মই হলো প্রবহমানতা— শূন্যতা থাকলে তা ভরাট করে, দুর্বল থাকলে তাকে হটিয়ে দেয়। যা চটকদার উত্তেজক তা সাময়িকভাবে প্রাধান্য পেলেও স্থায়ী প্রভাব পড়ে যা অপেক্ষাকৃত গভীর ও খাঁটি, তার। তা ছাড়া সংস্কৃতির একটা ওপরকার রূপ আছে যেখানে অদলবদল বেশি ঘটে, আর একটা ভেতরকার প্রাণ আছে যার পরিবর্তন ঘটে খুব ধীরে, সমকালে বোঝা যায় না, কালের দূরত্ব থেকে উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশ দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, চরম দারিদ্র্য এবং দীর্ঘদিনের লক্ষ্যহীন রাজনীতির কারণে বর্তমান উন্নত সব চলমান সংস্কৃতির অধিকারী নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুটি ভিন্নমুখী বাস্তবতার সৃষ্টি হয়— সংস্কৃতির বহিরঙ্গের শূন্যতা ও দুর্বলতা মেটানোর জন্য বাইরের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে, আর দীর্ঘ অবদমন ও চাপের ফলে অন্তরঙ্গে সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার জন্ম নেয়। এ ধরনের সমাজে বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে বিপরীতমুখী টানাপড়েন চলতে দেখা যায়— যা আমরা আমাদের সমাজে লক্ষ করছি। অন্তর্গতভাবে রক্ষণশীল মানুষ অবসর কাটাতে নির্ভর করেন এমন সব চলচ্চিত্রের ওপর, যা তার ধর্মীয় রক্ষণশীল মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না।

আমাদের দেশে বর্তমানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগ্রাসনের পর্যায়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে তিনটি জিনিসের— কেবল ও ভিডিওর কল্যাণে মুম্বাইয়ের বাণিজ্যিক ছবি, টেলিভিশনের সুবাদে পশ্চিমা বাণিজ্যিক ছবির অনুষ্ঠান, নানা ধারার পপ মিউজিক। আগ্রাসন এ কারণে যে, এসবের সঙ্গে একটি ভিন্ন জীবনব্যবস্থা ও জীবনাচরণ চলে আসে, যা আমাদের মৌল জীবন বোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এক্ষেত্রে নির্বিচারী হওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ধুয়াটিকে রাজনৈতিক মতলবে যারা ব্যবহার করতে চান, তারা দ্রুত তা ফিট করে দেন ভারতবিরোধী রাজনৈতিক প্রচারণার মধ্যে। ভারতবিরোধী রাজনীতি দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সূত্রে তৈরি হতে পারে ও তার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে। কিন্তু স্থায়ীভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের যে ধুয়া তোলা হয় তা বিচার করে দেখা প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের প্রসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন যে, বহু ক্ষেত্রে একই উত্তরাধিকারের কারণে এটা ঘটাই স্বাভাবিক এবং তা ঘটবে। অনেকেই বলেন এবং কোনো কোনো পত্রিকায় নিয়মিত অভিযোগ তোলা হয়, ভারতীয় শিল্পীর আগমন, লেখকের আগমন, ভারতীয় বই ও পত্র-পত্রিকার আমদানির ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। শিল্পী নিয়ে আসেন শিল্প আর লেখক ও বইপত্র থেকে পাওয়া যায় চিন্তাভাবনা— এ দু’য়েরই লক্ষ্যস্থল মানুষের অন্তরঙ্গের সাংস্কৃতিক প্রাণটি যা রসাস্বাদন করে, মনন করে এবং তার এই প্রক্রিয়া ধীর ও স্থিত। এতে ব্যক্তিমানুষের মানসজগৎ যেমন তেমনি সমাজের সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ হয়, আগ্রাসনের সুযোগ আর ঘটে না। আগেই বলেছি আগ্রাসনের ঘটনাটি প্রধানত ঘটে বহিরঙ্গে সংস্কৃতির রূপের ক্ষেত্রে, যা ঘটতে পারে ভারতীয় বাজারে হিন্দি ছবির মাধ্যমে। যদি মানুষের যাতায়াতেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘটে, তাহলে তা ঘটতে পারত বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের ওপর। কোনো কোনো মৌলবাদী পত্র-পত্রিকার হিসাব মতেই ভারতে উচ্চ পর্যায়ে পঠনরত বাংলাদেশি ছাত্র ও স্কলারের সংখ্যা বর্তমানে লাখের বেশি। এভাবে চিকিৎসার জন্য, বিয়ের বাজারের জন্য, তীর্থের জন্য, অবকাশযাপনের জন্য প্রতিবছর ভারতে যত বাংলাদেশি যান সে সংখ্যা এদেশে আগত ভারতীয়ের সংখ্যার চাইতে কয়েক গুণ বেশি হবে। আমাদের গানের শিল্পী, নাটকের দল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লেখক-শিক্ষকও সংখ্যানুপাতে ভারতে বেশি যান। কিন্তু দেখা যায়, সেক্ষেত্রে এদের মাধ্যমে ভারতে বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের প্রত্যাশার চাইতে আশঙ্কা প্রকাশ পায় এরাই সাংস্কৃতিকভাবে মগজধোলাই হয়ে ফিরবে কি না।

ঠাণ্ডা মাথায় নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে তখন বলতে হয় যে, আসলে সাংস্কৃতিক আস্থাহীনতায় ভুগছি আমরা। এর সহজ কারণ তিনটি— দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতা, শিক্ষার সুস্থ সাংস্কৃতিক আবহ তৈরিতে ব্যর্থতা এবং তার ফলে অন্ধসংস্কারের প্রভাব ও মুক্ত চিন্তাচর্চার অভাব এবং তৃতীয়ত, দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের ফলে গণতান্ত্রিক অধিকার ও সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং এর ফলে মানবিক বিকাশের পরিবেশ ও আস্থার অভাব। যদি অবস্থা এ রকম হয় যে, কেউ আমার কাছে এলে আমি প্রভাবিত হই, আবার আমি কারো কাছে গেলে তার দ্বারা প্রভাবিত হই, তাহলে বুঝতে হবে যে, হয় আমি এখনো অপরিণত অথবা আমার যোগ্যতার অভাব আছে।

আগের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, দারিদ্র্যের কারণে মানুষ বাছবিচার করতে পারে না, শিক্ষার অভাবে মানুষের বিচারবুদ্ধি বিকশিত হয় না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে মানুষ আত্মবিকাশের সুযোগ না পেয়ে আস্থাহীনতায় ভোগে বলে সে রকম সমাজে বহিরঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ-আগ্রাসন ঠেকানো যায় না। এই কথাটিরই রেশ টেনে বলা যায়, যেকোনো রকমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন-অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হলে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা বিস্তার এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ আবশ্যিক। এ কাজ বাদ দিয়ে বা এর অগ্রাধিকার স্বীকার না করে কেবল ধুয়া তোলার রাজনীতি চালাতে থাকলে সংস্কৃতির অন্তরঙ্গের প্রাণশক্তি হ্রাস পেয়ে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও পতন সম্পূর্ণ হতে দেরি হবে না।

এ পর্যায়ে দেশের মূল কার্যক্রম হিসেবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার বিস্তার ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতদানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পাহারাদারির ক্ষেত্রে সাধারণ মানবিক রুচি ও শিক্ষার পরিপন্থী যেকোনো ধরনের চলচ্চিত্র বা সিডি, ভিডিও ইত্যাদির ঢালাও অনুপ্রবেশ রোধ করা দরকার। বিদেশি টিভি অনুষ্ঠান ও চ্যানেল চালু করার আগে নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মানোন্নয়ন, বৈচিত্র্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধি অপরিহার্য ছিল। শিক্ষাঙ্গনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়ানো দরকার যাতে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজ নিজেই শিল্পসংস্কৃতির শরিকদার হতে পারে। এতে তার নিছক ভোক্তার ভূমিকা পাল্টে যাবে।

দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও স্বৈরাচারী শাসনের কারণে মানুষের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এ সমাজ শিল্পসংস্কৃতির উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ে মূলত এর ভোক্তায় পর্যবসিত হয়েছে। ঠিক ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ায় যেমন আমরা বিদেশি পণ্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছি, তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও একই ঘটনাই ঘটছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও মানের অবনতি অব্যাহত থাকায় সামর্থ্য থাকলেও যেমন উচ্চ শিক্ষার জন্য মানুষ বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে তেমনি তা ঘটছে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও।

সংস্কৃতির বিনোদনমূলক যে দিক তাতে ক্রীড়ায় সম্পূর্ণ বিদেশনির্ভর না হলেও আমাদের নিজস্ব ক্রীড়া জগতে ক্রিকেট ব্যতীত অন্যান্য খেলা মানুষকে টানতে পারছে না। সমাজে, বিশেষত শিক্ষাঙ্গনে খেলাধুলার প্রচলন, এতে আগ্রত তৈরি, নিয়মিত উপভোগের মতো প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং ধারাবাহিকভাবে মানোন্নয়ন ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা যাবে না। তারা টেলিভিশনের ক্রীড়া চ্যানেলেই আসক্ত থাকবে। এদিকে চলচ্চিত্রের বিনোদন-বাজার প্রায় ধসে পড়েছে। এটি পুনর্গঠনে আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ, যেমন সিনেপ্লেক্স নির্মাণ ও উন্নতমানের রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। নয়ত আমরা হয় সম্পূর্ণ বিদেশনির্ভর অথবা বিদেশি ভাবধারায় এদেশীয় রদ্দি চলচ্চিত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাজার সংকোচনের বৃত্তেই বাঁধা পড়ব। দেখা গেছে সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য ইত্যাদি শিল্পকলার ক্ষেত্রে— যে কলা সংস্কৃতির অন্যতম বাহন— ভারতসহ উন্নত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ আমাদের নিজেদের উৎকর্ষ সাধনে সাহায্য করছে। সবাই স্বীকার করেন যে, স্বাধীনতার পর আমাদের নাটক অনেকখানি এগিয়েছে। এর পেছনে যে ভারত ও বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। সঙ্গীত ও নৃত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্য ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ বিশেষ কার্যকর হয়েছে।

ফলে বোঝা যায় যে, একতরফা ধুয়া তোলার মধ্যে রাজনৈতিক মতলবই কাজ করে, জাতির উন্নতি বিকাশ মর্যাদা ইত্যাদি নয়। স্বচ্ছ দৃষ্টিতে যুক্তিবিচার করে বিষয়টি নিয়ে ভাবলে এর সমাধান এ রকম— অগ্রাধিকার পাবে দারিদ্র্যমোচনের লক্ষ্যে উন্নয়ন, পশ্চাৎপদ ও সঙ্কীর্ণ বদ্ধ চিন্তার গণ্ডি পেরুনোর উপযুক্ত আধুনিক শিক্ষার বিস্তার, মানবিক বিকাশের অনুকূল ও ব্যক্তি স্বাধীনতার গ্যারান্টিসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ। সবল সুস্থ মানসিকতা, উন্নত নৈতিকতা ও প্রাণবন্ত রুচিসমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন শৈশব থেকে সুকুমার শিল্পের চর্চার উপযোগী পরিবেশের নিশ্চয়তা— কি শিক্ষাঙ্গনে কি পরিবার জীবনে।

একই সঙ্গে সংস্কৃতির বহিরঙ্গের বিনোদনমূলক অংশে আমাদের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার আলোকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। সংস্কৃতির অন্তরঙ্গের অংশ ভাববিনিময়, সৃজনশীল শিল্পের আদান-প্রদান ও চিন্তার লেনদেনের সুযোগ যতটা সম্ভব প্রসারিত করতে হবে।

সংস্কৃতির শীর্ষ প্রকাশ হচ্ছে শিল্প— নিছক বিনোদনমূলক নয়, সৎ শিল্পের— এবং তা চর্চা আশানুরূপ মানে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের সুযোগ ও শিক্ষার পরিবেশ দান একান্ত জরুরি। এসব ক্ষেত্রে গোঁড়ামি, অন্ধতা বা বিরুদ্ধতা সৃষ্টি আখেরে দেশের শিল্পের মান কমায় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতির বিকাশ, খেসারত দিতে হয় দেশকে, বিনষ্ট হয় দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads