• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

আমরা বনাম তোমরা

  • চিররঞ্জন সরকার
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সুসাহিত্যিক ও বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী ‘আমরা ও তোমরা’ নামে এক প্রবন্ধে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভাজন নিয়ে এক অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রথমেই সেই প্রবন্ধটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যাক : ‘‘তোমরা ও আমরা বিভিন্ন। কারণ তোমরা তোমরা, এবং আমরা আমরা। তা যদি না হত তা হলে ইউরোপ ও এশিয়া এ দুই, দুই হত না- এক হত। আমি ও তুমির প্রভেদ থাকত না। আমরা ও তোমরা উভয়ে মিলে, হয় শুধু আমরা হতুম, না হয় শুধু তোমরা হতে।

...তোমরা দৈর্ঘ্য, আমরা প্রস্থ। আমরা নিশ্চল, তোমরা চঞ্চল। আমরা ওজনে ভারি, তোমরা দামে চড়া। আমরা বাচাল, তোমরা বধির। আমাদের কাছে যা সত্য, তোমাদের কাছে তা কল্পনা; আর তোমাদের কাছে যা সত্য, আমাদের কাছে তা স্বপ্ন।

...তোমরা বিদেশে ছুটে বেড়াও, আমরা ঘরে শুয়ে থাকি। তোমাদের আদর্শ জানোয়ার, আমাদের আদর্শ উদ্ভিদ। তোমাদের সুখ ছটফটানিতে, আমাদের সুখ ঝিমুনিতে। সুখ তোমাদের রফবধষ, দুঃখ আমাদের ৎবধষ। তোমরা চাও দুনিয়াকে জয় করবার বল, আমরা চাই দুনিয়াকে ফাঁকি দেবার ছল। তোমাদের লক্ষ্য আরাম, আমাদের লক্ষ্য বিরাম। তোমাদের নীতির শেষ কথা শ্রম, আমাদের আশ্রম। ...অর্থাৎ এক কথায়, আমরা চাই এক, তোমরা চাও অনেক। আমরা একের বদলে পাই শূন্য, তোমরা অনেকের বদলে পাও একের পিঠে অনেক শূন্য।’’

একসময় ‘আমরা-তোমরা’র বিভাজনটা ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে। এখন সেটা ভর করেছে আমাদের মগজে। আমাদের পরিবারে, সমাজে, রাজনীতিতে। আর তাই মহামহিম সুকুমার রায় ‘হিংসুটেদের ছড়া’য় লিখেছেন, ‘আমরা সবাই লক্ষ্মী ভালো তোমরা অতি বিশ্রী/তোমরা খাবে নিমের পাচন আমরা খাব মিশ্রী।’ আমাদের সমাজটা দিন দিন সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো ‘আমরা-তোমরা’য় বিভাজিত হয়ে পড়েছে। সবখানে দুই পক্ষ, আমরা আর তোমরা। এর বাইরে কেউ নেই কিছু নেই। আমরা খুব সহজেই ছাপ্পা মেরে দিই। হয় এ পক্ষ নয়তো ওই পক্ষ। আমরা-তোমরার বাইরে কাউকে রাখতে চাই না। পক্ষের বাইরে কেউ থাকতে পারে তা আমরা বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করতে চাই না। সবখানে সবকিছুতে বিভাজন, সবখানে আমরা-তোমরা। সবখানে দুটি পক্ষ আমরা খাড়া করে রেখেছি। এর বাইরে কোনোকিছু ভাবতে, মানতে পারি না। এ পক্ষ বলছে, আমরা ভালো তোমরা খারাপ। আবার ও পক্ষ বলছে, তোমরা খারাপ আমরা ভালো!

আপনি আওয়ামী লীগ না বিএনপি? আপনি আবাহনী না মোহামেডান? ইন্ডিয়া না পাকিস্তান? আপনি গোপালগঞ্জ না বগুড়া? বরিশাল না নোয়াখালী? পদ্মার এপার না ওপার? ইংরেজি না হিন্দি সিনেমা? আপনি সমুদ্র না পাহাড়? সরকারের পক্ষে না বিপক্ষে? আস্তিক না নাস্তিক? আপনি কোন দলে? হাসিনা না খালেদা? আওয়ামী লীগ না বিএনপি? আবাহনী না মোহামেডান? ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? ইলিশ না চিংড়ি? ভাত না রুটি? আমরা হয় এ পক্ষ নয়তো ও পক্ষ। আপনি যদি মাঝামাঝি থাকেন, তবে তা থাকতে দেওয়া হবে না। হয় ওপক্ষে ঠেলে দেওয়া হবে। না হলে এপক্ষে টেনে নেওয়া হবে। আমাদের মধ্যে সমন্বয়ের ভাবনা নেই। কেবল আছে বিভেদ, দ্বন্দ্ব, কোন্দল।

আমাদের রাজনীতিও ঝগড়া-মারামারি, কলহ-কোন্দলনির্ভর। সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে কেবলই দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর সংঘর্ষের খবর। দলে দলে ঝগড়া, মারামারি; নেতায় নেতায় রেষারেষি, মারামারি; উপদলীয় কোন্দল, এই কোন্দলকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেই নয়; বিভিন্ন পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, এমনকি ব্যক্তির মধ্যেও কলহপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পুরো দেশটাই বর্তমানে কলহ-কোন্দলের দেশে পরিণত হয়েছে।

জাতি হিসেবে আমরা কতটা শান্তিপ্রিয় আর কতটা কলহপ্রিয় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখ দিয়েছে। অনেকে মনে করেন, বাঙালি চিরকালই নিরীহ, শান্তিপ্রিয়। সহজে এদেশের মানুষ মুখও খোলে না। প্রতিবাদও করে না। মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়ে এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে ঝগড়া-কলহ এড়িয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার বিদ্যায় পারদর্শিতা দেখিয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, বাঙালি আসলে ভীষণ কোন্দলপরায়ণ, ঝগড়াটে জাত। এদেশের অধিকাংশ মানুষের পেটভর্তি হিংসা, মাথাভর্তি জিলেপির প্যাঁচ। আরেকজনের সর্বনাশ কামনা করা ছাড়া অনেকেরই কোনো ধ্যান নেই। অন্যেরটা মেরে, আরেকজনেরটা ঠকিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা ছাড়া অধিকাংশ বাঙালির কোনো সংকল্প বা জ্ঞান নেই। অন্যের সঙ্গে তো বটেই, বাঙালি চিরকাল স্বজনদের সঙ্গেও পায়ে-পা দিয়ে ঝগড়া করে। কলহ-কোন্দল ছাড়া বাঙালির পেটের ভাত হজম হয় না, বাঁচতেও পারে না।

আমাদের দেশের মানুষ সম্পর্কে এই উভয় ধরনের মতই হয়তো সত্যি। এখানে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে কলহপরায়ণ ঝগড়াটেও। তবে দিন দিন কী এক অজ্ঞাত কারণে এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের লোকের সংখ্যাই বাড়ছে। স্বার্থপর, ঝগড়াটে, হিংসুটে মানুষগুলো ক্রমেই সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, ছাত্রসংগঠনে, পেশাজীবী সংগঠনে, প্রশাসনে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি মন্ত্রিপরিষদেও এখন কোন্দলপ্রিয় স্বার্থপর হিংসুটেদের ভিড়। এই মানুষগুলো কেউ কাউকে দেখতে পারে না, পছন্দ করে না। কেবলই একে-অপরকে ল্যাং মারার চেষ্টা, পারস্পরিক ধস্তাধস্তি। একে-অপরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা।

বর্তমানে সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। আওয়ামী লীগ-বিএনপি, ছাত্রদল-ছাত্রলীগের মধ্যেই শুধু নয়- আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রদল, বিএনপির সঙ্গে বিএনপিরও কলহ বাধছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দল ও সংগঠনের মধ্যে ঝগড়া-কলহ তো রয়েছেই, দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও এখনো নিয়মিত ঘটনা।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, যত মত তত পথ। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে, যত মাথা তত মত। আর মত মানেই হচ্ছে মতপার্থক্য বা কোন্দল। আমাদের দেশে এখন কোনো বিষয়েই দুজন মানুষও একমত হতে পারে না। সবারই আলাদা আলাদা মত বা মতাদর্শ আছে। একজনের মতের সঙ্গে আরেকজন কেবল দ্বিমত পোষণই করে না; নিজের মতকে যদি কেউ গ্রহণ করতে না চায় তবে তাকে খুন করতে পর্যন্ত উদ্যত হয়।

প্রায় সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের বর্তমান বাংলাদেশে অসংখ্য মত, আর বিভিন্ন মতের অনুসারী অসংখ্য দল রয়েছে। এই দলগুলোর মধ্যে দলাদলি, ঝগড়া, গুঁতোগুঁতি লেগেই আছে। এমনকি এক দলের মধ্যেও ঐক্য নেই। সেখানেও ঝগড়া-ফ্যাসাদ-কোন্দল। আমাদের দেশে এখন যত মাথা তত মত, তত দল। আর দল মানেই হচ্ছে কোন্দল। দেশে বর্তমানে মত ছাড়া মানুষ নেই; কোন্দল ছাড়া দল নেই। কেউ কাউকে মানে না। সবাই সবার প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী।

কেউ কাউকে কোনো বিষয়েই ছাড় দিতে চায় না। ফলে ঝগড়া-বিবাদ-মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমেই বাড়ছে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মতপার্থক্য বাড়ছে। দলে দলে শত্রুতা বাড়ছে। দলের মধ্যেও উপদলীয় কোন্দল বাড়ছে। সবার সঙ্গে সবার অলিখিত শত্রুতা, ঝগড়া। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া, মন্ত্রীতে মন্ত্রীতে দ্বন্দ্ব। এক মন্ত্রী আরেক মন্ত্রীকে সহ্য করতে পারছেন না। সুযোগ পেলেই একে অপরকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

বর্তমানে পরিবারে দ্বন্দ্ব, ক্লাবে দ্বন্দ্ব, দলে দ্বন্দ্ব, মন্ত্রিপরিষদে দ্বন্দ্ব, প্রশাসনে দ্বন্দ্ব, বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব, জোটে দ্বন্দ্ব, ছাত্রসংগঠনে দ্বন্দ্ব, আইনজীবী সংগঠনে দ্বন্দ্ব- সবখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। কারো মধ্যে সহিষ্ণুতা নেই, ধৈর্য নেই, নেই কোনো আদর্শ। সবাই শ্রেষ্ঠত্ব চায়, অর্থ চায়, ক্ষমতা চায়, নিরঙ্কুশ প্রভাব-প্রতিপত্তি চায়। এসব ক্ষেত্রে কেউ কোনো রকম ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সবাই সবাইকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। সুস্থ প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কারো মধ্যে নেই। এখন সবাই জয় চায়, কিন্তু কোনো রকম প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায় না। উন্নতি ও কল্যাণের জন্য দলের নেতাকর্মী তো বটেই, এমনকি বাপকেও গলা ধাক্কা দিতে কেউ আর কসুর করছে না। নিজের আখের গোছানোর ক্ষেত্রে যে যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী বা পথের কাঁটা মনে করছে, সে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাই তো ঝগড়া-বিবাদ, কলহ-কোন্দল ক্রমেই বাড়ছে।

গত দু-তিন দশক ধরে এদেশের মানুষগুলোকে যেভাবে লোভ আর হিংসার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়েছে, যেভাবে ভোগবাদী ও স্বার্থপর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে, তাতে করে আর যা-ই হোক, এদেশের মানুষের মধ্যে শান্তি, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান কিংবা সম্প্রীতি আশা করা যায় কি? আর তা যদি না যায়, তাহলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-কোন্দল নিরসনের উপায় কী? দল-উপদল-কোন্দলই কি তবে আমাদের অনিবার্য নিয়তি?

বঙ্কিমচন্দ্র একবার বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালী শুধু কান্দে আর উচ্ছন্নে যায়।’ আজো অবস্থা ঠিক তা-ই। আমাদের চারপাশের আলো ক্রমশ নিভে আসছে! 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads