• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
জীবনানন্দ কেন বেঁচে আছেন

জীবনানন্দ দাশ

সংরক্ষিত ছবি

সাহিত্য

জীবনানন্দ কেন বেঁচে আছেন

  • মাসুদুজ্জামান
  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০১৮

নশ্বর শরীর আমাদের। একসময় তিরোহিত হয়ে যায় এই পৃথিবী থেকে। কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায় না আমাদের আবেগ-অনুভূতি। পরম্পরিত হয়ে বহমান থাকে মানবপ্রবাহে। এই আবেগ বহমান রাখেন লেখকেরা। কিন্তু সব লেখক ভাবি কালের পাঠকদের কাছে সেটা বহমান রাখতে পারেন না। তবে যিনি পারেন তিনি পেয়ে যান চিরায়তের শিরোপা। জীবনানন্দ দাশ পেরেছিলেন। পেরেছিলেন বলেই আজও পাঠকের কাছে তার কবিতা সমাদৃত হয়ে আসছে। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? নিঃসন্দেহে তিনি যে-সময়ে কবিতা লিখে থাকুন না কেন, সময়োত্তীর্ণ হয়েছে বলেই তার কবিতা আমাদের আজও ভালো লাগে। আমরা পড়ি আর শিহরিত হই। পল সেলানই বলেছিলেন, কবিতা সময়ের দ্বারা বিভাবিত না হলে কবিতা হয়ে ওঠে না। পল সেলানের কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন জাক দেরিদা। হেগেল আরও আগে বলেছিলেন শিল্পের লক্ষ হচ্ছে সমগ্রতার সন্ধান। ব্যক্তিসত্তা বিকাশের সূত্রে অর্জিত হয় এই সমগ্রতা। জীবনানন্দ দাশও এই সময়ের দ্বারা প্রাণিত হয়েই কবিতা রচনা করেছেন। তিনি নিজেই এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা; সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা।’ বোঝা গেল, কবিতায় থাকবে সময়ের কথা।

কিন্তু মানুষ কী পৌঁছুতে পেরেছে সেই জীবনে, যে-জীবনকে তার মনে হতে পারে সম্পূর্ণতার অনুভবে, আবেগে সংরাগে দীপ্ত? ঢের দিন মানুষ পৃথিবীতে এসেছে ঠিকই কিন্তু মানুষই এই পৃথিবীকে করে তুলেছে অমানবিক : ‘ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছি পৃথিবী ভরা আলো/তবুও গভীর গ্লানি ছিল কুরুবর্ষে রোমে ট্রয়ে;/উত্তরাধিকারে ইতিহাসের হূদয়ে/বেশি পাপ ক্রমেই ঘনালো।’ জীবন আসলে এরকমি। ‘না’-এর ভেতর থেকে তার কবিতায় ঘনিয়ে ওঠে ‘হাঁ’-এর ইতিবাচক অনুভব। বৈপরীত্যের এই বোধ সময়েরই প্রতিচ্ছবি।

কী ভয়াবহ এক নির্জনতা আর নৈঃসঙ্গ্যের মধ্য দিয়ে চলেছেন তিনি, ‘আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়ার ভিতর।’ পৃথিবীকে তার মনে হয় ‘অমেয় তিমির মৃতদেহের দুর্গন্ধের মতো।’ চারিদিকে সে বানিয়ে রেখেছে ‘হাড়ের পাহাড়’। কলকাতার পথে হাঁটতে গিয়ে তার মনে হচ্ছে, ‘পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন, — মাথার ওপরে/অসংখ্য জটিল তারের জাল/শাসন করছে আমাকে।’ শুধু কী মহানগর কলকাতা, অঘ্রাণের মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেন, ‘নাই জ্যোৎস্না — নাই কো মল্লিকা।’ হরিণ খেয়ে ফেলে আমিশাষী শিকারীর হূদয়। এরকম পরিস্থিতিতে তো মানুষের মনে হতেই পারে, ‘বধূ শুয়ে ছিলো পাশে - শিশুটিও ছিলো;/প্রেম ছিলো, - আশা ছিল - জ্যোৎস্নায়, - তবু সে দেখিল কোন ভূত?’ জীবনানন্দের ভাবনা এই শূন্য, রিক্ত, রক্তকলরোলময় রূপান্তরহীন নারকীয় জীবনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতে চায়নি। কেননা তিনি মনে করেন, ‘মানুষ বিশেষ কিছু চায় এই পৃথিবীতে এসে/অতীব গরিমাভ’রে বলে যায় কথা;/যেন কোনো ইন্দ্রধনু পেয়ে গেলে খুশি হ’তো মন।’

এভাবেই ইতিবাচক জীবনের দিকে ঘুরে গেছেন জীবনানন্দ দাশ। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন, ‘প্রেম — স্বপ্ন - পৃথিবীর স্বপ্ন, প্রেম তোমার হূদয়ে।/হে স্থবির, কী চাও বলো তো - শাদা ডানা কোনো সারসের মতো?’ কবি এসে দাঁড়ান সবুজ মাঠে-ঘাসে, তিনি লক্ষ করেন, ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে।’ প্রকৃতির কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে আসেন, অনুভব করেন ধানসিড়ি নদী, ভাটফুল, শঙ্খচিল, উঠানে খই ছড়িয়ে দেয়া শিশুটিকে। মানুষের এভাবেই বার বার জন্ম হয়। এভাবেই কী মানুষ চায় ‘অনির্বচনীয়/স্বপ্নের সফলতা - নবীনতা - শুভ্র মানবিকতার ভোর?’ মানবিকতার এই যে প্রতিষ্ঠা, জীবনানন্দের কবিতার এটাই হচ্ছে মৌলিক বিষয়। তার কবিতার সামগ্রিক তাৎপর্য এইখানে যে, আধুনিক মানুষ এক জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই সময়প্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে কারও পক্ষেই পুরোপুরি ইতিবাচক জীবনের কথা বলা সম্ভব নয়। মানুষের সংকল্প আশা সমর্পিত থাকে অনেককিছুতেই, আছে ‘নতুন ব্যাপ্তির অনুভব’। তবু সে সফলতা পায় না : ‘মানুষ এ পৃথিবীতে ঢের দিন আছে;/সময়ের পথে ছায়া লীন/হয়নি এখনও তার, তবুও সে মরুর ভিতরে/একটি বৃক্ষের মত যেন যুক্তিহীন।’ মানুষ আসলে যা ভাবে, যে স্বপ্নের কথা বলে, হূদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত না হলে, আন্তরিকতার ছোঁয়া না থাকলে তা অর্থহীন হয়ে যায়। ভাষার মতোই তা ‘অনুভূতি দেশ থেকে আলো/না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কংকাল/জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।’

জীবনানন্দ এই যে অনুভূতির কথা বললেন, তার ব্যাখ্যাও সহজ নয়। হূদয়ই হচ্ছে তার কাছে ‘অনুভূতি দেশ’। নারীর কথা, প্রেমের কথা এভাবেই তার কবিতায় হূদয়ের পথ ধরে আসে। নারীর প্রতি তার যত আগ্রহ তাও ওই হূদয়ের জন্যেই। বনলতা সেন বা সুরঞ্জনার কথা এভাবেই তিনি তার কবিতার বিষয় করে তোলেন। নারী এজন্যেই তার কাছে ‘শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো’। ইতিহাসের মধ্যেই যেমন ঘটেছে রক্তপাত, তেমনি এই ইতিহাসের অভিজ্ঞানই তাকে দিয়েছে শুশ্রূষা। তিনি মনে করেছেন, ‘ভাবা যাক — ভাবা যাক —/ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি/ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত/শত জলঝরনার ধ্বনি।’

জীবনের এই হচ্ছে বহুমাত্রিকতা, জটিলতা। জীবনের ভেতর থেকেই উত্থিত হয় জীবন — আরেক জীবন, যে-জীবন মানবিক হয়ে উঠতে চায়। ‘মানবতা’ আর ‘সময়’ এ দুটি শব্দ ঘুরে ফিরে আসে তার কবিতায়। এই দুটি অনুষঙ্গের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেই তিনি মানুষের পরিপূর্ণ রূপটি লক্ষ করবার চেষ্টা করেছেন। সময়ের ব্যবহার তার কবিতায় এত তীব্র আর গভীর যে সহজেই তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

সত্তার ঊর্ধ্বায়ন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গেই সম্পর্কিত হয়ে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, বলেছিলেন হাইদেগার। আমাদের মানবিক সত্তাকে এভাবেই কবিতায় উপজীব্য করেছেন জীবনানন্দ। এটাই হচ্ছে তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাঠক নিজের আত্মাকে, আত্মস্বরূপকে, অর্থাৎ জীবনের সমগ্রতাকে জীবনানন্দের কবিতায় খুঁজে পায় বলেই এখনও তার কবিতা জননন্দিত হয়েও শৈল্পিক উৎকর্ষে অনন্য। কবি হিসেবে তার বেঁচে থাকবার মূল সূত্র হচ্ছে তিনটি : (এক) সময়কে স্পর্শ করেছে; (দুই) আমাদের প্রতিটি মানবিক আবেগ-অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে, আর (তিন) যাবতীয় কাব্যিক অলঙ্কারসহ একধরনের স্মার্ট বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে গেছেন তিনি। এ কারণেই তাকে যেমন ‘আধুনিক’ কবি বলে চিহ্নিত করা হয়, তেমনি তিনি ‘উত্তর-আধুনিক’ও। আসলে তিনি একাধারে সমকালকে স্পর্শ করেছেন আবার ভবিষ্যস্পর্শীও বটে। জীবনানন্দের কবিতা তাই কখনও পুরনো হয় না। তার প্রয়াণকে স্মরণ করে কুর্নিশ বাংলা ভাষার এই প্রধান কবিকে।  ৎ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads