• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এবং অ্যালেন গিন্সবার্গ

  • হিমেল আহমেদ
  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে আজো বিভীষিকাময় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১-এ বিশ্বের সেরা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাপোর্ট দিলেও যেমন পিছপা হয়নি বাংলাদেশ, তেমনি বিশ্বের মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বরা। কবি আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ তাদের মধ্যে একজন, যিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক অসহায় বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞের চিত্র বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে। অ্যালেন গিন্সবার্গ একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী ও মঞ্চ অভিনেতা। মানবতার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ  বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন মানবতার চরম লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর চলা অন্যায়, নির্যাতন ও বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এই মহান সমাজকর্মী। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন এসেছিলেন বাংলাদেশে। নিজ চোখে বাঙালিদের দুর্দশা দেখে লিখে ফেলেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এই কবিতাটি সর্বকালের সেরা কবিতার একটি হয়ে আজো বেঁচে আছে।

গিন্সবার্গ তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন। সে সময় গিন্সবার্গ এদেশে এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশের সংযোগস্থল যশোর রোড হয়ে। যুদ্ধে অসহায় বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোডের চারপাশে আশ্রয় শিবির তৈরি করেছিল। গিন্সবার্গ এসেছিলেন যুদ্ধাহতদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। কিন্তু বাঙালিদের দুর্দশা দেখে তিনিও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি লেখার অনুপ্রেরণা এখান থেকেই তিনি পান। ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো ‘যশোর রোড’। বাংলার ইতিহাসে যশোর রোড বিখ্যাত স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। এই যশোর রোডের দু’পাশে আজো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দুইশ বছর বয়সী হাজারো গাছ। আশ্রয়ের খোঁজে অসহায়, নির্যাতিত বাঙালি এই রোড ধরেই ভারতে গিয়েছিল। গিন্সবার্গ স্বচক্ষে দেখেছিলেন যশোর রোডের চিত্র। যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা যুদ্ধাহত বাঙালিদের শরণার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি তার ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়। গিন্সবার্গের এই কবিতাটি ১৯৯৯ সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তার ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। গিন্সবার্গের কাছে গিয়ে অনুমতি নিতেও সফল হন তিনি। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিল। তাই এটাকে গান করার দায়িত্ব পড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের ওপর। মৌসুমি ভৌমিক কবিতাটি গান হিসেবে গেয়েছেন এবং জয় করে ফেলেন হাজারো শ্রোতার মন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র মুক্তির গান থেকে গিন্সবার্গের কবিতাটি বাদ পড়ে যায়।

গিন্সবার্গ শুধু যে সাহিত্যিক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী। সত্যিকার অর্থে একজন সমাজকর্মী, মানবতার সেবক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি, যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে গানে রূপান্তর করে ‘কনসার্ট ফর বাঙালি’ নামে গানের প্রোগ্রাম করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ করা। গিন্সবার্গের এই মহৎ উদ্যোগে এগিয়ে আসেন অনেকেই। এই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজসহ আমেরিকার আরো অনেক জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তি গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়, যা সব যুদ্ধাহত বাঙালির সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গিন্সবার্গের করা এই কনসার্টের মাধ্যমে বিশ্ব জেনেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা।

গিন্সবার্গ ছিলেন আমেরিকার প্রথম সারির একজন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারকর্মী। ১৯৫৫ সালে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দেশটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই যুদ্ধের বিরোধিতায় নামেন। আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ। অনেকের কাছেই এই আন্দোলন হিপ্পি মুভমেন্ট নামেও পরিচিত। ১৯৬৫ সালে এই আন্দোলনের কর্মীরা একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধ রুখতে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল, তখন এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবেই কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সৃষ্টি করেন ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’। বন্দুকের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেন ফুলকে! আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন গিন্সবার্গ নিজেও। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে ফুল হয়ে ওঠে প্রধান হাতিয়ার। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধীর অন্যতম নেতা ছিলেন গিন্সবার্গ। ঠিক একইভাবে অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিতদের পাশে এসে দাঁড়ান। বাংলাদেশ তার এই অকৃত্রিম বন্ধুকে চিরকাল স্মরণে রাখবে।  

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads