• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

সালাম সালেহ উদদীনের সাহিত্য

  • আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০১৮

প্রতি বছর একবার করে সুযোগ আসে অনেকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার। এই মিলনমেলায় মিশ্র শ্রেণির ব্যক্তিরা আসেন—সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী ও জীবনের অন্য স্তরের পরিচিতরা। খোলা প্রাঙ্গণে আলোর ছটা, আলাপের গুঞ্জন, সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা সবই থাকে। সবশেষে আপ্যায়ন। এই আপ্যায়ন দেখেই মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে থাকে। এত লোককে রেস্তোরাঁয় আপ্যায়নে বেশ খরচ হয়। আমি হলে পারতাম না, কিন্তু সালাম সালেহ উদদীন তা পারেন। তার বুকের পাটা আছে। সাংবাদিক-সাহিত্যিকের মেলবন্ধন তাকে একটা শক্তি দিয়েছে, দিয়েছে আন্তরিকতাও। বছরে একদিন আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হবে সবার সঙ্গে— মানুষ তো একবারই জন্মগ্রহণ করে (অবশ্য, জাতিস্মর না হলে), সেই জন্মেরও মূল্য আছে, আনন্দের অভিসার আছে।

সালাম সালেহ উদদীন প্রতিবছর তার জন্মদিন পালন করেন আর বয়স বাড়িয়ে তোলেন। সেই সঙ্গে আমাদেরও মনে হয় একই কথা। আমরাও ক্রমশ পরপারের আহ্বান শুনতে পাচ্ছি নিঃশব্দে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি আশি বছরেও বৃদ্ধ না হন, অনবরত হাতের কলমে ব্যস্ততা থাকেন, তাহলে সালামেরও বয়স বাড়বে না, আর আমরাও রবীন্দ্রনাথের ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে পারব নিরাপদে, বোধহয় নিরাভয়েও।

সালাম সালেহ উদদীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমাদের ছাত্র ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস করতেন না, তবে টিউটোরিয়াল ভালো লিখতেন। এই লেখা থেকে বোঝা যেত, পড়ালেখা করলে তিনি অনায়াসেই ভালো রেজাল্ট করতে পারতেন। কিন্তু পড়াশোনার সময় কোথায়? কাজের ব্যস্ততা পড়ার টেবিলে বইকে দূরে সরিয়ে রাখত। ছাত্রজীবন থেকেই সংবাদপত্রে চাকরি করতেন। সে সময় দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ বেশ খ্যাতি অর্জন করে। এখানেই প্রথম দুই পৃষ্ঠা ধরে উপ-সম্পাদকীয় প্রথম প্রকাশিত হতে থাকে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট নাম করেছিল। ‘আজকের কাগজ’ মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তান আমলে ঢাকার ২৬৩ নম্বর বংশাল রোড থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘সংবাদ’-এর কথা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সব সংবাদপত্রের নাম ছিল অবাংলা- ইত্তেহাদ, ইনসাফ, আজাদ, ইত্তেফাক, মিল্লাত আর এসবের পাশে বাংলা নাম নিয়ে প্রকাশিত হলো দৈনিক সংবাদ। শুধু নাম নয়, এখানেই প্রতিটি ছোট আকারের কার্টুন ছাপা হতো, চমৎকার সংবাদের মান আর বলিষ্ঠ সাহিত্যের পাতা। ‘আজকের কাগজ’ও প্রথমে ভারী হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সালাম সালেহ উদদীন এখানেই ঢুকলেন সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে। আজকের কাগজ আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেলে সালাম আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী এই তরুণ মনোবল হারাননি। নিজেকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে যোগ দিলেন দৈনিক ‘যায়যায়দিন’-এ। দিন যায়, মাস যায়, সালামের জীবনও কাটে দিন আর মাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। চাকরি করার সময়েই তার দ্বৈত সত্তা গড়ে ওঠে— একদিকে সাংবাদিকতা আর অন্যদিকে সাহিত্য রচনা। সাংবাদিকতা পেশার পাশেই গড়ে ওঠা দ্বিতীয় সত্তাও তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রকাশিত হতে থাকে তার গল্প ও উপন্যাস।

সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্য রচনার মধ্যে সবসময় অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয় না। টিএস এলিয়েট তার একটি প্রবন্ধে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। সাংবাদিকরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তৃত সংবাদ প্রকাশের চেষ্টা করেন কিন্তু সাহিত্যিকরা এই দিকটি এড়িয়ে যান। তাদের কাছে স্পেস বাঁচানো নয়। বর্ণনার বিস্তৃতির মধ্যে মানুষের জীবন-সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সালাম সালেহ উদদীনের রচনায় কি এই দ্বন্দ্ব আছে? দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু সাহিত্যে সাংবাদিকতার প্রভাব আছে। উপন্যাসের কাহিনী প্রকাশে বর্ণনাত্মক দিকই বেশি প্রাধান্য পায়। ঔপন্যাসিক নিজেই বিভিন্ন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, মনোভাব, গতি ও সংঘাতের বর্ণনা দেন, উপন্যাসের চরিত্ররা দ্বন্দ্বকে বেছে নেন না। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কি কোনো দুর্বলতা আছে? এটা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল পাঠকদের মানসিক বৈশিষ্ট্যের ওপর। কোনো পাঠক বর্ণনাধর্মী উপন্যাস পছন্দ করেন, আবার অনেকে আছেন যারা সংলাপধর্মী ঘটনার প্রতি দুর্বল। সালাম এখানে একটি কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি বর্ণনার মাধ্যমে কাহিনী বিকাশের পাশাপাশি কয়েকটি প্রয়োজনীয় দৃশ্যে সংলাপের দ্বারস্থ হন। এর ফলে আকস্মিকভাবে বর্ণনারীতি ভেঙে গিয়ে কথকতা রীতির আবির্ভাব ঘটে। বাংলা উপন্যাস রচনায় বেশিরভাগ সাহিত্যিকই বর্ণনার মাধ্যমে ঘটনা ও চরিত্রের অন্তর্গত রূপ প্রকাশে অগ্রসর হন। পাঠকের কাছে অতিরিক্ত বর্ণনাত্মক রীতি অনেক সময় কৌতূহল দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক ঘটনার অনবরত পরিবর্তন নির্দেশ করলে পাঠক অন্তর্নিবিষ্ট হতে সক্ষম হন। সালাম সালেহ উদদীন সাংবাদিকতা পেশাকে গ্রহণ করায় সাংবাদিকতার রীতি উপন্যাস রচনায় প্রভাব ফেলা অস্বাভাবিক মনে করার কোনো কারণ নেই।

সালাম সালেহ উদদীন বেশকিছু উপন্যাস লিখলেও সেগুলো পড়ার সুযোগ হয়নি বলে এ বছর ‘যায়যায়দিন’-এ প্রকাশিত তার ‘ব্যর্থ দিন ব্যর্থ রাত’ পড়ার জন্য হাতে নিয়েছিলাম এবং শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বর্তমান উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে একজন জীবন-অনভিজ্ঞ সাদাসিধে মানুষের ব্যর্থ জীবন স্বপ্নের সংঘাতকে কেন্দ্র করে। অন্যভাবে বলা যায়, উপন্যাসের কাহিনী বর্তমান সময়ের সমাজব্যবস্থা ও মানুষের মানসগঠনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। একজন সাধারণ মানুষ, যে জীবন-শাসনে অক্ষম অথচ স্ত্রীর অনাচার বন্ধ করতেও অপরাগ। তার ফলে নায়ক প্রকাশ প্রতি পদক্ষেপে হয়েছে পরাজিত, মানসিকভাবে দারুণ বিপর্যস্ত এক মানসিক রোগী। সে পাপাচারী স্ত্রীকে হত্যা করতে গিয়ে বারবার মানসিক প্রতিঘাতে পিছিয়ে আসে। প্রকাশের পৌরুষকে অনবরত আঘাত দিলেও সে স্ত্রীর কাছে পচনশীল এক পাথর। ঔপন্যাসিক নায়ক প্রকাশের মানসিক সংঘাত ও দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণে অনবরত অগ্রসর হয়েছেন কিন্তু প্রতিকারের পথ নির্দেশ করেছেন মানুষের জীবনকে আঘাত না করে মধ্যপন্থি পথ অনুসন্ধানের মধ্যে। প্রকাশ আর স্ত্রী হত্যার দিকে অগ্রসর হবে না, নিজেদের সন্তানকে নিয়েই বেঁচে থাকবে, স্ত্রী জাহান্নামে গমন করলেও সেদিক থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে। মেয়ে নম্রতাকে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার যে ইচ্ছা প্রকাশের ঔপন্যাসিক তার প্রকাশ করেছেন এভাবে :

‘মা-হারা মেয়ের ভবিষ্যৎ তার জানা আছে। বাবা যার মাকে হত্যা করেছে পরকীয়ার দায়ে, সে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন চলার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধা, দুর্নাম, অপবাদ কাজ করে, ছায়ার মতো পেছনে অনুসরণ করে। এসব সহ্য করে নম্রতাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হতো, অথবা তার জীবন থেমে যেত।’

সালামের সাহিত্যিক জীবনে একটা পজিটিভ মতাদর্শ আছে বলে মেয়ের স্বার্থে প্রকাশ স্ত্রী পলির কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ঔপন্যাসিকের এই মনোভঙ্গির বিশেষ একটা মূল্য থাকতে পারে। কারণ অনেক ঔপন্যাসিক পলির জীবনের পরিবর্তন আনতে পারতেন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। অথবা ক্ষুধার বর্ণনায় পলির জীবনই লন্ডভন্ড করে দিতে পারতেন। সালাম সালেহ উদদীনের সাহিত্যে যে আদর্শের প্রতিফলন ঘটছে তা দ্বন্দ্বমুখর জীবনকে অন্য প্রান্ত দেখে পর্যবেক্ষণের কারণে। এ কারণে তার রচনাও স্বতন্ত্র হয়ে ধরা পড়েছে পাঠকের চোখে। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads