• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ওয়ারিশ

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

ওয়ারিশ

  • মনোজিৎকুমার দাস
  • প্রকাশিত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

পটলার বরাবরই ইচ্ছে, এমন একজন শ্বশুরের মেয়েকে সে বিয়ে করবে, যার কোনো পুত্রসন্তান থাকবে না। শ্বশুরের পুত্রসন্তান না থাকলে একদিন সে বিনাপরিশ্রমে শ্বশুরের সহায়-সম্পত্তির মালিক হবে। সে তার মা বিরজাসুন্দরীর মাধ্যমে বাপ শ্রীগোকুল চোকদারকে তার মনের বাসনার কথা জানিয়ে দেয়। এলাকার নামকরা ঘটক বিরিঞ্চি প্রামাণিক একুনে ঊনচল্লিশটি মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় পটলার বাপের কাছে। কিন্তু একমাত্র পুত্ররত্নের শর্ত পূরণ না হওয়ায় ঘটক প্রত্যেকবারই ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর পটলার মনের বাসনা পূরণ করেন করণকান্দির দুই কন্যার মা কিরণবালা ও বাবা শ্রীবাসের বড় কন্যা মালতিরানীর সঙ্গে পটলার পরিণয় সুসম্পন্ন করে।

মালতিরানীকে সুশ্রীবতী বলতে হয়। তাকে বিয়ে করার পর পটলা ওরফে পটলকুমার চোকদার ডিএম কোর্টে চাপরাশির চাকরি পাওয়ায় সে ভাবে, তার বউ মালতিরানী বেজায় পয়মন্ত। বছর তিনেক যেতে না যেতে তার বউ তাকে একটা পুত্রসন্তান উপহার দিলে পটলা বউয়ের ওপর বেজায় খুশি হয়। তখন পটলার মনে খুশি আর ধরে না! শ্বশুরের অগাধ সহায়-সম্পত্তি। একমাত্র শ্যালিকা কমললতা দিনে দিনে বিয়ের বয়সী হয়ে উঠছে। দেখতে শুনতে কমললতা মালতিরানীর চেয়ে সুন্দরী। পটলকুমার মানে আমাদের পটলা ভাবে, দিনে দিনে কমললতা যেন নববর্ষার জলের কলমির মতো লাবণ্যময়ী হয়ে উঠছে। কী সুন্দর মুখশ্রী, দেহবল্লরী যেন তন্বীতনুলতার মতো। এক সন্তানের মা মালতিরানীর পাশে কমললতা দাঁড়ালে পটলার ইচ্ছেই হয় না নিজের বউয়ের দিকে তাকাতে। তার মনে শঙ্কা জাগে কমললতার অন্যত্র বিয়ে হলে শ্বশুরের সম্পত্তির একজন ভাগীদার জুটবে। বিষয়টি ভেবে পটলার কপালে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে।

এদিকে মালতিরানী আবার সন্তানসম্ভবা হয়। সাত মাস চলছে। আলট্রাসনো করে পটলা জানতে পারে, এবার তার বউয়ের কন্যাসন্তান হবে। সোয়ামির মুখ থেকে খবরটা শুনে মালতিরানীর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে এই ভেবে যে একটা ছেলের পিঠে একটা মেয়ে! ভগবান তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু পটলা কন্যাসন্তানের কথা শুনে মোটেই খুশি নয়, খবরটা শোনার পর পটলার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। সে রাগের মাথায় বউকে বলে, ‘প্যাট খালাস করে ফেলতি হবি, মদনার বউ প্যাট ফেলানোর...’ সোয়ামির কথা শুনে মালতিরানী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সোয়ামিকে গালিগালাজ করতে থাকে। পটলার পোয়াতি বউ বাপের বাড়ি চলে যায় তার পরদিনই। বাপের বাড়ি গিয়ে মালতিরানী ভাবে, তার যদি একটা ভাই থাকত, তবে সে সবচেয়ে আহ্লাদিত হতো। মালতিরানী ভাবে, তাদের মা-বাবার বয়সই বা কত! এখনো যদি তাদের একটা পুত্র জন্মাতো তবে একদিন তার ভাই শাস্ত্রীয় বিধিবিধান পালন করতে পারত।

এদিকে মালতিরানীর সোয়ামি পটলার মনে অন্য ভাবনা কাজ করতে থাকে। পটলার বন্ধু সুনীতকুমারের শ্বশুরের পুত্রসন্তান নেই। দুটিই কন্যাসন্তান। পটলা ভাবে, সুনীত বড়ই ভাগ্যবান! সে গত বোশেখে তার ছোট শ্যালিকা চম্পকলতাকে বিয়ে করে শ্বশুরের সমস্ত সহায়-সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার পথ সুগম করেছে। সুনীতের বড় বউ শ্যামাবতী ছোট বোন চম্পকলতাকে সতীন হিসেবে মেনে নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে। পটলা প্রায়ই সুনীতের সঙ্গে ঘুজুর-ফুসুর করে। সুনীত পটলাকে যুক্তি দেয় কমললতাকে বিয়ে করে শ্বশুরের সম্পত্তি ভাগাতে। মালতিরানীর ভয়ে পটলা কথাটা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে পাড়তে সাহস করে না। সে সুনীতকে বলে, ‘আমি তোর বউদি মাগীকে বশে আনতি পারব না নে। তোর বউটা তো তোর নেওটা! যা কলি তাতেই হুঁ।’

ঈশ্বর কেন যেন পটলার ইচ্ছাকেই পূরণ করলেন। আট মাসের শেষদিকে মালতিরানীর গর্ভপাত হওয়ায় সোয়ামির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। অসুস্থ শরীরে মালতি বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে এসে সোয়ামির রণচণ্ডী রূপ দেখে আঁৎকে ওঠে। এটাই মোক্ষম সময় বুঝে পটলা বউকে বলল, ‘কমললতাকে সাথে আনোনি ক্যানে। নিজির তো এহন কোনোই মুরোদ নেই। কমললতাকে সাথে আনলি কাজকাম করে দিতি পারত!’
সোয়ামির কথার জবাবে মালতি মিনমিনে গলায় বলল, ‘তার পড়াশোনা আছে না! কমললতা তুমার শালী। সে ক্যানে আমাদের সেবাযত্ন করতে আসবি!’ বউয়ের কথা শুনে পটলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘সুনীতের শালী ক্যানে তার দিদির ওখানে থাকত? একসময় তো ওর দিদিই তার বাপকে বলল, ‘চম্পকলতার বিয়ে জন্য পাত্র না খুঁজে ওকে তোমার বড় জামাই সুনীতের সাথে বিয়ে দিলে ভালো হয়। আমরা মিলেমিশে থাকব, তোমার অগাধ সম্পত্তির অন্য ভাগীদার কেন আনবে?’ সোয়ামির কথা শুনে মালতি বুঝতে পারল তার মতলবটা। ‘সম্পত্তির লোভে তুমার বউ নিজের একমাত্র বোন কমললতাকে সতীন বানাতে পারবে না জেনে রেখো তুমি! আমি বাপের সম্পত্তির জন্য লোভী হতে যাব কোন দুঃখে। মনে রেখো, সুনীতের বউয়ের মতো আমি লোভী নই।’

পটলা অবস্থা বেগতিক দেখে সুনীতের শরণাপন্ন হলো। সুনীত সব কথা শুনে পটলাকে বলল, ‘কৌশল বদলাতে হবে বুদ্ধু। ভালোবাসার ভান করে কার্যসিদ্ধি করা লাগবে। বউকে এমনভাবে আদর-সোহাগ করতে হবে, যাতে তোর বউই একদিন নিজে প্রস্তাব দেবে কমললতাকে তোর সঙ্গে বিয়ে দিতে। আমার বউকে দেখে তুই কিছু শিখতে পারিসনি? বাড়ি যাওয়ার আগে তুই তোর বউয়ের জন্য শাড়ি, ব্লাউজ, দামি পাউডার-সেন্ট এমনকি ৩৪-৩৫ সাইজের ব্রাও গোটা তিনেক কিনে নিয়ে বাড়ি যাবি। গঞ্জেরর সময় ময়রার রসমালাই ও ক্ষীরের চমচম নিতে কিন্তু ভুলিস্ নে।’ কথাগুলো বলে সুনীত ফিক করে হেসে ফেলে। সুনীতের বলা নতুন থেরাপি প্রয়োগ করতেই যেন মালতি সোয়ামির কথায় ওঠবস করতে শুরু করলেও একদিন মালতিরানীর মনে হলো, তার ধুরন্ধর সোয়ামি নতুন কোনো মতলব ফাঁদছে না তো!

মোবাইল ফোনটা হঠাৎ নষ্ট হওয়ায় সে তার ছোট বোন কমললতার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। পাশের বাড়ির মিঠুন মোবাইল ফোন মেরামত করে, তার কাছেই মালতি ফোনটা সারাতে দিয়েছে। সোয়ামির ফোনে কমললতার সঙ্গে কথা বলতে মালতির ইচ্ছে করে না। মালতি বুঝতে পারে কমললতার ওপর তার সোয়ামির নজর ভালো না। মায়ের সঙ্গে মালতির কথা বলতে সবসময়ই ইচ্ছে করে। সেদিন সন্ধ্যায় মিঠুন মোবাইলটা মেরামত করে মালতিকে ফেরত দিয়ে গেছে। ওইদিন সন্ধ্যার পরে ফোনে রিংটোন বেজে উঠলে মালতি ভাবে, কমললতা না হয়ে পারে না। সত্যি কমললতা!

ফোন রিসিভ করলে কমললতা যা বলে তা শুনে মালতি আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ে। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কমললতা বলে, ‘আমাদের ভাই আসছে রে দিদি!’ ছোট বোনের কাছ থেকে সব কথা শুনে মালতিরানীর আনন্দ আর ধরে না। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের বাপের সম্পত্তির একজন ওয়ারিশ আসছে! পরক্ষণেই তার মনে পড়ে তার লোভী সোয়ামিটার মুখ, যে কি-না শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তির মালিক হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এই খবরটা জানার পর কী লঙ্কাকাণ্ডই না বাধাবে সে তার সঙ্গে, তা ভেবে মালতি আতঙ্কিত হয়!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads