• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
চেতনায় আলো আর ভালোর কারুকাজ

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

তপন বাগচী

চেতনায় আলো আর ভালোর কারুকাজ

  • প্রকাশিত ০৫ জানুয়ারি ২০১৯

একুশের কবিতা সংকলন তপন বাগচী সম্পাদিত, ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প গবেষণা-তপন বাগচী, বাংলা একাডেমির সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বা সাংগঠনিক কোনো কাজ; সেখানেও তপন বাগচী। তাকে ছাড়া যেন পূর্ণই হয় না আমাদের ঋদ্ধ করার কোনো প্রক্রিয়া। আর এর নেপথ্যে রয়েছে তার সর্বোচ্চ ত্যাগ, জানা এবং বোঝার জন্য নিরন্তর পড়াশোনা। তিনি পড়েন বেশি, লেখেন কম। যে কারণে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বরাবরই তার কর্মকান্ডে মুগ্ধ হয়েছি। ২০০১ থেকে চলমান সময় অবধি কেবলই মনে হয়েছে নিবেদিত মানুষদের কোনো প্রতিচ্ছবি কখনো আঁকলে অবশ্যই তপন বাগচীর মুখচ্ছবিটিই আঁকবো। ‘রাগ-রাগিণী’ শিরোনামের একটি গীতিকবিতায় আমাদের ভালোবাসা-ভালোলাগাকে কত গভীরভাবে নিয়ে এসেছেন তিনি তার শব্দ আর বাক্যের নিপুণ গাঁথুনিতে :

কী করে গাইব তোমার এ-গান
শিখিনি তো রাগ-রাগিণী
ভুলে গেছি আমি সুর-তাল-লয়
আমি কী যে হতভাগিনী\

কতবার তুমি পাশে এসে বসে
ডাকনাম ধরে ডেকেছ
আজকে তোমার নাম ভুলে গেছি
তুমি ঠিকই মনে রেখেছ
ঘুমে-জাগরণে স্বপনে দেখেছি
দুই চোখ মেলে জাগিনি\

তপন বাগচী একাধারে কবি, গীতিকার, ছড়াকার, প্রবন্ধকার, কথাশিল্পী, গবেষক এবং শিল্পী। তার শিল্পিত আগামী তিনি নিজের মতো করে গড়েছেন। যেখানে তিনি যাত্রাশিল্পের ওপর দীর্ঘ সময় অবিরত অক্লান্ত পরিশ্রম সঞ্চয় করে রেখেছেন ঠিক এভাবে— ‘একসময় তোতার সঙ্গে গুনাইয়ের বিয়ের আয়োজন হলে দলিলুদ্দিন ক্ষেপে ওঠে। সে গুনাইয়ের একভাই খালেককে লোভ দেখিয়ে বড় ভাই রফিককে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পরামর্শ দেয়। তোতা গুনাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে শোনা যায় চিরায়ত বিয়ের গান, ‘আজ বুঝি তোরে যাবে লইয়া লো বুবুজান/আজ বুঝি তোরে যাবে লইয়া\/শ্বশুরবাড়ি যাবি রে তুই ঘোমটা মাথায় দিয়া/হলুদ বরণ অঙ্গে দেব হলুদ মাখাইয়া\/হায় হায়!/সবাই মিলে দিবে তোরে গোছল করাইয়া\।’ বিয়ের আনন্দ-আয়োজনের ফাঁকে গুনাইয়ের ছোটভাই বিষ খাইয়ে বড়ভাইকে মেরে ফেলে। পরে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে খালেক নিজেও বিষপানে আত্মহত্যা করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে। দুই ভাইকে হারিয়ে গুনাইকে কণ্ঠের সুরে ফুটে ওঠে হাহাকার ধ্বনি, ‘আগে যদি জানতাম গো দাদা/জানতাম গো দাদা- যাইবা গো ছাড়িয়া/জন্ম আমি নিতাম না দাদা, তোমার বইন হইয়া\’
তোতার বিয়ের পরেও দলিলুদ্দিনের ষড়যন্ত্র থামে না। তোতার ঘর পুড়িয়ে দেয়। এখন কী আর করা! তোতা সংসার খরচ জোগানোর জন্য বরিশাল শহরে যেতে চাইলে গুনাই নিষেধ করে। নিষেধের বাণী ফুটে ওঠে গুনাইয়ের গানে, ‘চাকরিতে না যাইও রে বন্ধু/চাকরিতে যাইও না/চাকরির নামে বিদেশ যাইয়া ভুইলা থাইক না।’ দলিলুদ্দিন গুনাইকে দেখার জন্য বাড়ির পাশে একটি বকুলগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। তোতার গাছটি কেটে ফেলার জন্য মালিক কাঠুরিয়াকে ডাকে। মালিক গাছচাপা পড়লে তাকে রক্ষা না করে বরং মেরে ফেলে। তারপর পুলিশ ডেকে তোতাকে ধরিয়ে দেয়। তোতার ঠাঁই হয় বরিশালের কারাগারে। এবার দলিলুদ্দিন গুনাইকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু যাত্রার বিবেকের মতো এক দরবেশ দলিলুদ্দিনকে গানে গানে সতর্ক করিয়ে দেয়। কোকিলের ডাকে বিরহী গুনাইয়ের অন্তর কেঁদে ওঠে। তাই গেয়ে ওঠে, ‘ও কোকিল ডাইকো না ডাইকো না/ওই কদমের ডালে/শত বসন্ত সুখের কালে/আমার পতি নাই ঘরে।’

অনবদ্য তার গবেষণা, শিল্প সাধনা। অনেকেই এখন লিয়াজোঁ করে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কারটি বাগিয়ে নিচ্ছেন; এই ধারা অবশ্য স্বাধীনতার আগে থেকেই চালিয়ে আসছিলেন সুযোগ-সন্ধানী লেখক-কবিগণ। যারা রাজনৈতিক মদতপুষ্ট হয়ে আজো জিইয়ে আছেন নিজেদের অবস্থানসহ; তাদের জন্য নিবেদিত থাকা কবি তপন বাগচী হতে পারেন ‘মদতপুষ্টতা’ ‘তৈলমর্দন’-এর বিপরীত উদাহরণ। তিনি সাহিত্যে তার দীর্ঘ কর্ম নিবেদন করার পর ‘মহাকবি মধুসূদন জাতীয় পদক ২০১১’ পেয়েছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও যশোর জেলা প্রশাসন প্রবর্তিত এই সম্মাননা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন। বর্তমানে কবি ও গবেষক তপন বাগচী বাংলা একাডেমির সংকলন উপবিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য নিবেদিত আছেন নিরন্তর। কবিতা লেখার নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে তপন বাগচী কবি শামসুর রাহমান, আবুবকর সিদ্দিক, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, আবিদ আনোয়ার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা বলেন। আর প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তিনি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সুকুমার বিশ্বাস, মাহবুবুল হক, স্বরোচিষ সরকার, অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখর কাছে ঋণ স্বীকার করেন।
আমাদের এই ক্ষয়ে যাওয়ার সময়ের লেখকগণ তো সম্মানও করতে ভুলে যাচ্ছেন, আর সেই ভুলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসার জন্য নিজের লেখার মধ্যে তপন বাগচী সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন বিনয়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে। এমন একজন নিবেদিত সাহিত্যজনের সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো ভাবতাম কবি বা লেখকগণ হয়তো তাদের-ই মতো অধিকাংশ যারা নিজের নামের সঙ্গে ভিনদেশি নাম, পাশ্চাত্যের রাজনীতিক-সাহিত্যিকদের নাম যুক্ত করে কাক থেকে ময়ূর হতে চায়! আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের দিকে তাকালে এর দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। বাংলাদেশের সাহিত্যকে বাঁচাতে হলে এখন এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে।

 

মোমিন মেহেদী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads