• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বই আমাদের মানবিক করে তোলে

পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরি গ্রিসের এপিসাস

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

জার্নাল জনান্তিকে

বই আমাদের মানবিক করে তোলে

  • মাসুদুজ্জামান
  • প্রকাশিত ০৫ জানুয়ারি ২০১৯

গল্পটা ছেলেবেলার। সত্যিকার এক জীবনের গল্প। শান্ত মফঃস্বল একটা শহর। রেলকলোনির ধূসর সারি সারি বাড়িগুলো ছাড়া উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। শহরটাকে দুভাগ করে দিয়ে এর মাঝ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। মনে হতো, এই রেললাইনের একপ্রান্ত উত্তর মেরুতে, আরেক প্রান্ত দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে মিশবে। রেলকলোনি ছাড়া সরকারি কিছু বাড়িঘরও ছিল। শহরের অভিজাত বাড়ি বলতে সেই বাড়িগুলোকেই বোঝাতো। কিন্তু তাও ছিল হাতে গোনা। এর বাইরে ছড়ানো ছিটানো টিনের ঘর, কয়েকটা স্কুলবাড়ি, রেলস্টেশন আর বাজার মিলিয়ে এই শহর। ছোট্ট একটা শহর। তবে ছোট্ট হলে কী হবে, এর নামটা বেশ রাজকীয় — রাজবাড়ী। কোনো গঞ্জ বা পুর এই নামের সঙ্গে যুক্ত নেই। এই শহরের একটা জায়গাই সারাক্ষণ সরগরম থাকতো, সেটা হলো রেলস্টেশন। পাশেই বিস্তীর্ণ বাজার, তবে দুপুর হলে সেই বাজারটাও ঘুমিয়ে পড়তো। জেগে উঠতো সেই সন্ধ্যায়। এই শহরেই ছেলেবেলা কেটেছে আমার। বইয়ের সঙ্গে, বইয়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছি আমি।
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে কেঁপে ওঠেনি দেশ। শুধু পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কিছুটা নিস্তরঙ্গভাবে চলছে পাকিস্তানের পূর্বাংশ— পুব বাংলা। প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় কী ঘটছে, মফঃস্বল এই শহরে তার বিন্দুমাত্র কম্পন অনুভব করা যেত না। আগের দিন কী ঘটেছে সেই খবরের জন্যে প্রতিদিন সন্ধ্যের ট্রেন আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হতো। ওরকম একটা ট্রেনেই খবরের কাগজের বান্ডিলগুলো এসে পৌঁছুতো রাজবাড়ী রেলস্টেশনে। তারপর বাসি খবরের জন্যে সবার সে কী কাড়াকাড়ি। তো এরকম একটা শহরে বইয়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা সহজ ছিল না। কিন্তু একদিন প্রায় আকস্মিকভাবে আমার সামনে খুলে গেল সেই সিংহ দরোজা, যে-দরোজা পেরুতেই চোখে পড়লো রাশি রাশি বইয়ের সুসজ্জিত নীরব কুচকাওয়াজ। মনে হলো, শহরের সবচেয়ে ক্ষুদে পাঠককে ওই বইগুলো বিউগল বাজিয়ে অভিবাদন জানালো— স্বাগত তোমাকে। এবার তাহলে গল্পটা খুলেই বলি।
শহরের ঠিক মাঝখানটায় সজ্জনকান্দা নামের একটা গ্রাম। নামেই গ্রাম, আদতে জেলা শহরের কেন্দ্রেস্থলেই ছিল আমাদের বাসা। এর দু’দিকে দুটো স্কুল। একদিকে রাজবাড়ী সরকারি মডেল হাইস্কুল [এখন জেলা স্কুল] আরেক দিকে রাজবাড়ী সরকারি গার্লস হাই স্কুল। মাঝখানে আরও কয়েকটা বাসার সঙ্গে আমাদের বাসা। মেয়েদের স্কুলটা আমাদের বাসার গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে আর মডেল স্কুলটা বাসা থেকে দেখা যায়। আমি ছিলাম শহরের এই অভিজাত স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলে আসা-যাওয়া আর পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার জীবন। মাঝে মাঝে রেলওয়ে মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট থাকলে মেতে উঠতাম সেই উৎসবে। কখনও কখনও রেললাইন ধরে কয়েকজন বন্ধু মিলে চলে যেতাম অনেকটা দূরে, লোকোশেড পেরিয়ে নিস্তব্ধ কোনো ফসলের মাঠের পাশে গিয়ে বসতাম। অথবা বরফকল পেরিয়ে গ্রামের কোনো প্রান্তে।
একদিন হঠাৎ স্কুলের একটা নোটিশের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। মনে মনে ভাবলাম আমিও ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবো। প্রতিবছর তখন বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে আন্তঃস্কুল বক্তৃতা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো, এখনও হয়তো হয়। বয়সভিত্তিক ওইসব প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা ছিলেন মহামান্য মহকুমা প্রশাসক। আমি তখন নিতান্তই অপরিণত এক বালক। কিন্তু স্কুলে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে যে দেয়াল পত্রিকা বের হতো প্রথমে আমি ছিলাম তার লিপিকার, পরে সম্পাদক। তখন ওই পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে বেশ গলদঘর্ম হতে হতো। এই সময়েই দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় আমার। লক্ষ ছিল, কীভাবে সম্পাদকীয় লেখা হয় তার কলাকৌশল রপ্ত করা। যথাসময়ে প্রতিযোগিতার জন্য নাম জমা দিলাম। ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে নিদিষ্ট পরিসরে একটা রচনা লিখতে হবে। নাম জমা দেওয়ার মুহূর্ত থেকেই আমি টগবগ করে ফুটছি, ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত।
কিন্তু কী লিখবো আমি? কীভাবে শুরু করবো? কীভাবে শেষ করবো আমার লেখা? দুর্ভাবনায় দুদিন ঘুমোতেই পারলাম না। বিকেলে আমার বন্ধুরা যখন স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলায় মত্ত, আমি তখন ঘরের কোণে টেবিলে বসে চুল ছিঁড়ছি। এক বিকেলে টেবিলে মন বসছিল না। ভাবলাম, যাই একটু এদিক-সেদিক ঘুরে আসি। লক্ষহীনভাবে বাসার কাছাকাছি এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ পড়লো একটা হলুদ ভবনের ওপর। প্রধান সড়কের পাশেই এই ভবন। ভবনটির ওপরের দিকে কালো অক্ষরে লেখা ‘উডহেড পাবলিক লাইব্রেরি’। থমকে দাঁড়ালাম আমি। মনে হলো, এইতো পেয়ে গেছি। এই তো সেই রাজপ্রাসাদ যেখানে কোনো রাজকন্যা নয়, মানুষের জ্ঞান আর ভাবনা সাজিয়ে রাখা বইয়ের পাতায় পাতায় নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো আমার মর্মভেদী তীক্ষ দৃষ্টি আর হাতের স্পর্শে তার ঘুম ভাঙবে। কিন্তু ওই প্রাসাদে ঢুকবো কী করে? সামান্য পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান যার সেই ঘুটে কুড়োনির ছেলের কী এই জ্ঞানকেন্দ্রে প্রবেশাধিকার আছে? তবু কী ভেবে যেন হলুদ ওই ভবনটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিদ্যাধর ঘুমন্ত কোনো রাজকন্যা যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছোট্ট একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন উঁকিঝুকি দিচ্ছি, তখনই আমার পিঠে একজনের কোমল স্পর্শে চমকে উঠলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। আমাকে প্রশ্রয়ের চোখে দেখছেন, মুখে স্মিত হাসি। মুহূর্তেই আমার মনের মেঘ কেটে গেল। শান্ত কিন্তু আন্তরিক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী বই পড়তে চাও, খোকা? তাহলে আস, আমার সঙ্গে ভেতরে আসো।’ আমি তো দারুণ খুশি। দ্বিধাকম্পিত পায়ে তাকে অনুসরণ করে সেই যে ওই লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়লাম, আজও আমার তা থেকে মুক্তি ঘটেনি। পৃথিবীর যেখানেই আমি যাই, যে শহরে — হতে পারে হয়তো পড়তে গেছি অথবা পড়াতে, কিংবা কোনো সেমিনারে যোগ দিতে, সময় পেলেই ছুটে যাই লাইব্রেরিতে অথবা কোনো বুকস্টলে। এই লাইব্রেরি আমাকে যতটা টানে, শপিং মল বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ততটা টানে না। বই আর লেখালেখিতেই কাটে আমার দিন।
আজ আর মনে নেই কে ছিলেন সেই মানুষটি, যিনি আমাকে সেদিন উডহেড লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই মনে পড়ে, তখনই আমি সকৃতজ্ঞ চিত্তে সেই মানুষটির কথা স্মরণ করি। এরপর যতদিন রাজবাড়ী থেকেছি, উডহেড লাইব্রেরিই হয়ে উঠেছিল আমার বৈকালিক তীর্থক্ষেত্র। হ্যাঁ, তীর্থস্থানই বলবো একে। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, মহাকালের কল্লোলিত সমস্ত জ্ঞান বইয়ের মধ্যে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকে। একে নিজের মতো করে জাগিয়ে তুলতে পারলেই জীবন রঙিন হয়ে উঠতে পারে। এভাবে যে-মানুষ বইয়ের অমৃতকথনের সন্ধান পেয়েছে, তার কাছে জাগতিক সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। আমারও সেদিন এরকম অবস্থাই হয়েছিল। আজও তাতে সম্মোহিত হয়ে আছি। নিমজ্জিত হয়ে আছি বইয়ের সমুদ্রে। এই লাইব্রেরির বইগুলোই আমাকে শিখিয়েছিল জীবন কত বড়, পৃথিবী কতটা মধুময়। বই যে কীভাবে মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে, প্রসারিত করতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের জীবন দিয়েই সেটা বুঝেছি। একজন মানুষকে মানবিক করে তুলবারও উৎস হচ্ছে বই। কিন্তু এক দিনে বই আমাদের হাতে আসেনি। সে আরেক ইতিহাস, বইয়ের চমকপ্রদ ইতিহাস। পরের জার্নালে এই বইয়ের কথা বলা যাবে। আপাতত শুধু এই বলে শেষ করি, পাঠক, আসুন বই পড়ে আমরাও মানবিক হয়ে উঠি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads