• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বদ্ধ দুয়ার ভাঙার হাতিয়ার

সংগৃহীত ছবি

সাহিত্য

বদ্ধ দুয়ার ভাঙার হাতিয়ার

  • প্রকাশিত ০৫ জানুয়ারি ২০১৯

আমরা যারা লিটলম্যাগ নিয়ে এত ভাবনার খোরাক জোগাই, আসলে সেই লিটলম্যাগের গোড়ার কথাটাও জানা প্রয়োজন। যতদূর জানা যায়, ১৭৩১ সালে এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত ‘জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিন’ প্রকাশের পর পরই ম্যাগাজিন শব্দটি বেশ প্রচলিত আকারে সাড়া পায়। পত্রিকার আকার বা সীমাবদ্ধতার কারণেই হয়তো ‘লিটল’ (তুলনামূলকভাবে ছোট, ক্ষুদ্র নয়) বোঝানোর সুবিধার্থে পুরো ইউরোপে এভাবেই এর চলন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। লিটন ম্যাগাজিনের প্রচার প্রসার বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে শুরু হলেও বোস্টন থেকে ১৮৪০ সালে ল্যাল্ফ ওয়ালডো এমারসন ও মার্গারেট ফুলার সম্পাদিত ‘দি ডায়াল’ পত্রিকাটিই লিটলম্যাগ গবেষকদের কাছে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে অনেক উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজ সমহিমায় উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। তরুণদের উৎসাহিত করেছে, লেখক তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখকরা একসময় এসব ছোটকাগজে লিখেছেন। পরবর্তীতে তারা নিজ নিজ স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। অনেক প্রবীণ লেখককে অকপটে স্বীকারোক্তি করতে শুনি যে জীবনের প্রথম লেখাগুলো ছোটকাগজের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই ছোটকাগজ আদপে ছোট নয়। তাকে ছোট বা ফেলনা করে দেখার সুযোগ নেই। লিটলম্যাগ বলতে আসলে আমরা কী বুঝে থাকি? লিটলম্যাগ বা যাকে আমরা বাংলায় বলি ছোটকাগজ, সেই ছোটকাগজ কী কারণে ছোট? আর কোন সংজ্ঞায় ছোট? এর মাত্রামাপক কোনো যন্ত্র আছে কি? ছোটকাগজ বলা হচ্ছে এর আকার-আকৃতির কারণে নাকি অবজ্ঞা-অবহেলার কারণে বা বোধশক্তির কারণে তাও ভাববার খোরাক জোগায়। বাংলা কবিতায় লিটলম্যাগের প্রসঙ্গ এলেই সর্বাগ্রে আমরা বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার কথা স্মরণে আনি। আবার অনেকে এ ‘কবিতা’ পত্রিকাটিকে লিটলম্যাগ মানতে চাননি। এটিকে একটা উৎকৃষ্টমানের সাহিত্য পত্রিকা বলেছেন। কিন্তু লিটলম্যাগ যে সব কমিটমেন্ট দাবি করে তা তাতে নাকি ছিল না। এ ধরনের বিস্তর আলোচনা হতেই পারে। ‘কবিতা’ পত্রিকাটি একটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে ছিল। লিটলম্যাগকে কেবল লেখার জন্যই না, একে একটি আন্দোলন হিসেবেও ধরা হয় যা একশ্রেণির বোদ্ধা পাঠক এ কথাই বিশ্বাস করে থাকেন। আবার আমরা যদি কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় লিটলম্যাগের স্থায়িত্বকালকে বিচার করতে যাই, তবে তিনি কী বলেছেন দেখি। তার ভাষায় : ‘এক দশকেই সঙ্ঘ ভেঙে যায়। দশক যায় দশক আসে। সঙ্ঘ ভাঙে সঙ্ঘ গড়ে।’ এই ভাঙা-গড়ার মাঝেই নতুন নতুন লিটলম্যাগ জানান দেয়, আসে-যায়, কেউ কেউ চেতনায় গেঁথে রাখে অনেকদিন ধরে। কাজের কাজ যে কিছুই হয় না তা কিন্তু নয়। অনেকেই আমৃত্যু লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছেন, বৈরাগ্য জীবনযাপন করেছেন। নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন।

লিটলম্যাগ শব্দটির সঙ্গে আরো একটি শব্দ জড়িত। সেই শব্দটি হলো আন্দোলন। কী সামাজিক আন্দোলন, কী শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও লিটলম্যাগ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। কারণ সামাজিক আন্দোলনগুলোও কখনো কখনো সাহিত্যের স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়। সামাজিক আন্দোলনগুলো লেখকদের কাছে টানে, তাদের বলে দিতে হয় না কী করতে হবে। লিটলম্যাগের প্রধান কাজই হচ্ছে নতুনের কেতন ওড়ানো। সব মিলিয়ে বলতে গেলে লিটলম্যাগকর্মীরা স্বাধীনভাবে মত ও পথের দিশা দেখাতে পারে। তার পত্রিকায় যে কোনো ধরনের লেখা বা মতামত প্রতিফলন করানো যায়। লিটলম্যাগ মফস্বলের অবহেলিত লেখককে তুলে আনতে পারে অবলীলায় এবং তারা সে কাজটি নিপুণভাবে করে যাচ্ছে। যা কোনো দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বা তারা সে কাজটি করার জন্য বস্তুত প্রস্তুতও নয়।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একদল নিষ্ঠাবান ছোটকাগজ কর্মীদের উদ্যোগে লিটল ম্যাগ মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে সারা দেশ থেকে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ পত্রিকা সম্পাদক ও পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের এক মিলনমেলা, প্রাণের মেলায় পরিণত হয় এসব আয়োজন। কোনো রকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজ উদ্যোগে একদল লিটলম্যাগকর্মী সাহসী উচ্চারণে উদ্দীপ্ত হন। তারা তাদের প্রাণের তাগিদ থেকে দূর-দূরান্ত পাড়ি দিয়ে এ ধরনের শিল্প-সাহিত্যের আসরে সমবেত হন। প্রচলিত ও প্রথাগত ধারার বাইরে নতুন কিছু তৈরি করার মানসে ছোটকাগজের জন্ম। ছোটকাগজ কিন্তু আসলে ছোট কিছু নয়, এর ব্যাপ্তি বিশাল আর এটির ধারণক্ষমতাও অনেক বেশি। বাণিজ্যিক কাগজের সঙ্গে ছোটকাগজের রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। বাণিজ্যিক কাগজের যেখানে রয়েছে মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা, সেখানে ছোটকাগজ অনেকটা বেপরোয়া। বাধাহীন নতুনদের লেখার খোলা তলোয়ারস্বরূপ কাজ করে।

 

আনোয়ার কামাল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads