• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভাষার খোঁজে

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

ভাষার খোঁজে

  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০১৯

কদিন হয় জয়ের হাতে আর কাজ ওঠে না। ফেলে রেখেছে সে সবকিছু। স্যারকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কথা, তাও হচ্ছে না, থাকার রুমটিও ঠিকমতো গোছানো হয় না। টেবিলে বইগুলো এদিক-ওদিক পড়ে আছে। ধানমন্ডি মডার্ন হাসপাতালে মাকে দেখতে যাওয়ার কথা। অথচ কোনো কাজেই তার মন নেই। একটি মেয়ে, কেবল একটি মেয়ে তার যাবতীয় শৃঙ্খলাকে নষ্ট করে দিয়েছে। কী নাম মেয়েটির তাও জানা হলো না। না জানলেও জয় মনে মনে তার নাম দিয়েছে রিয়া। কী শান্ত তার মেজাজ! কী শান্ত চোখ! অনেক খুঁজেও মেয়েটির আর সন্ধান পায়নি সে। নাম পরিচয়হীন মেয়েকে ঢাকায় কোথায় পাবে সে, তা-ই ভাবছে। অনেকটা নিজের ইচ্ছার বিরোধিতা করেই, স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে। বাসায় বড় বোন আর শুধু বাবা আছে তার। ছোট বোন হাসপাতালে মাকে দেখছে। বোনের দৃষ্টি এড়াতে দায়িত্ববানের ভঙ্গিতে বলল, ‘হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভুলে গেছ, আপু ?’
ভুলিনি। জানি তো আজ তুই যাবি। তবে মা সুস্থবোধ করলে বাসায় নিয়ে আসবি। হাসপাতালে চারতলায় জয় তার মায়ের সঙ্গে দেখা করল। ডাক্তার বলেছে শ্বাসকষ্ট কমেছে। তবে আর একদিন পর রিলিজ দেবে। কিছুই করার নেই। মায়ের খোঁজখবর করে বাসার কুশলাদি মাকে জানানোর পর সে বিদায় নিল। লিফটে পা বাড়াতেই তার চোখে পড়ল, সেই মেয়েটি। যার সন্ধান সে এতদিন করতে পারেনি। লিফটে আর তৃতীয় কেউ নেই। জয় ভাবছে আজ আর তাকে হাতছাড়া করবে না। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে রিয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, আপনাকে বাসাবো দেখেছিলাম, তাই না?’

রিয়া কোনো কথা বলছে না, শুধু মাথা নেড়ে ইতিবাচক জবাব দিল। জয়ের কৌতূহল আর অস্থিরতা এক হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ আবারো জানতে চাইল, ‘মনে পড়েছে? মাত্র সেদিন নৌকা থেকে রাস্তায় উঠতে পারেননি। আমি হাত বাড়াতেই আপনি উঠলেন।’ হ্যাঁ, রিয়ার সব মনে আছে। বন্যার সময় বাসাবো বেড়াতে গিয়েছিল সে। নিচু এলাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। নৌকা ছাড়া চলাচল ছিল অসম্ভব। তাই রিয়া মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সবই মনে আছে তার। রিয়ার দাঁড়ানো জবাবের ভঙ্গিতে কি যে জড়তা, তা জয়ের চোখ এড়ালো না। তাই লিফট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পর্যন্ত রিয়ার পিছু নিল সে। সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি কথা বলতে পারেন না?’ মাথা নেড়ে রিয়া ‘না’ জবাব দিল। ‘আমি দুঃখিত, আর একটু দুঃখ আপনার বাড়াবো। আমারই প্রয়োজনে।’ মুখ ঘুরিয়ে তাকালো রিয়া। জয়ের কথাটি ভালো লেগেছে তার। তাই মৃদু হাসিতে জয়কে আশ্বস্ত করে কথার সুযোগ দিল। ‘কীভাবে বাকরুদ্ধ হলেন? আমাকে বলুন প্লি¬জ’।

জয়কে রিয়ার ভালো লেগেছে। জয়ের মতোই রিয়াও ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু বাকরুদ্ধ মেয়ের ভালো লাগার কথা বলার অধিকার আছে? তাই তার কথাগুলো ছুড়ে দেয় ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসে। জয়কে সে জানাবে, সব জানাবে। একটি কাগজ বের করে রিয়া লিখে জানাল, ‘তার বড় ভাই ছিল। শান্ত ও ভদ্র প্রকৃতির স্বভাব ছিল তার। পড়াশোনা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া পর্যন্ত ছিল নিত্যদিনের রুটিন। এক রাতে এক সন্ত্রাসী ভাইয়ের বন্ধু বলে বাসায় ঢুকে আমার ভাইকে খুন করেছে। তার নাম ছিল সিরাজ। আজো জানা গেল না কী দোষ ছিল আমার ভাইয়ের। সেদিন এক চিৎকারে আমার মুখের ভাষা হারিয়ে গেল।’ এবার জয় যেন বাকরুদ্ধ। ছলছল চোখে রিয়া বিদায় নিল। জয়ও বাসার দিকে পা বাড়াল।

জয় ভাবে রিয়ার কথা। কী হবে রিয়ার? কে নেবে এই বিকল জীবনের দায়ভার? পাকবাহিনী চেয়েছিল বাঙালির মিষ্টভাষা এই বাংলাকে রুদ্ধ করতে। বুকের রক্ত দিয়ে হাজারো মানুষ সে ভাষাকে রক্ষা করেছিল। তবে কি সে পারবে না রিয়ার ভাষা ফিরিয়ে দিতে? জয়ের বিশ্বাস রিয়া একদিন কথা বলতে পারবে। নিজের ভাষায় একান্ত নিজের কথাগুলো জয়কে বলুক রিয়া। বাসায় ফিরেও জয়ের মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। ভাবছে রিয়ার বাসায় মোহাম্মদপুর কাল যাবে। জয় তাকে ডাক্তার দেখাবে। রিয়া রাখবে না তার কথা? হয়তো রাখবে। রিয়াও মন থেকে জয়ের কথা ভুলতে পারছে না। কিন্তু জয়কে ভালোবাসার সাহস সে রাখে না। সে মনোবল তার কোথায়? মুখের ভাষা হারিয়ে সে সর্বস্ব হারিয়েছে। রিয়ার বাকরুদ্ধতা দুজনের মাঝে আজ দুর্ভেদ্য দেয়াল।

সকাল আটটা বাজে। পত্রিকার জন্য রিয়া অস্থির হয়ে পড়েছে। ঠিক তখনই পত্রিকা চলে এসেছে। প্রথম পাতার শিরোনাম ‘র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সিরাজের মৃত্যু’। পড়ামাত্র রিয়া আনন্দে চিৎকার করে উঠল। রিয়া কথা বলতে পারছে। বাসায় অন্যান্যেরও আনন্দের শেষ নেই। সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। জয় এসে দরজায় নক করলে রিয়া দরজা খুলল, রিয়ার মুখে অপ্রতিরোধ্য হাসি দেখে জয় কিছুটা বিস্মিত। কারণ জানতে দেরি হলো না জয়ের। রিয়া ধীর, শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো আছ?’ ‘ভালো তো আছি। কিন্তু তোমার কথা শুরু হলো কীভাবে?’

তখন পত্রিকাটি জয়ের হাতে ধরিয়ে দিল রিয়া। জয় বিস্মিত। রিয়াকে আবিষ্কার করে ভাষার সন্ধান পেয়েছে বলে জয়ের আনন্দের শেষ নেই। জয়ের উল্ল¬াস আজ বিশ্বকাঁপা। জয়ের ইচ্ছে করে তার অদম্য কথাগুলো আজই বলে যায়। কিন্তু না, জয় বলবে না; তাই রিয়াকে বলে, ‘রিয়া আজ উঠি, শুক্রবার তোমাদের বাসায় মাকে পাঠাব। তুমি বাসায় থেকো।’

জয়ের এ আকস্মিক সংবাদে রিয়ার আনন্দ আকাশের সীমা ছাড়িয়ে যায়। জবাবে রিয়া শুধু মৃদু হাসল। সকালের সোনা রোদ কুচি কুচি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রিয়ার সমস্তটুকু জুড়ে।

 

 

রাশিদা বেগম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads